বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠিত শিল্পীই তাঁর অনুরাগী অথবা ছাত্র-ছাত্রী। অনেকেই তাঁকে অভিভাবকের আসনে বসিয়েছিলেন। কারণ প্রদীপ ঘোষের সান্নিধ্যে ছিল একদিকে স্নেহ, অন্য দিকে প্রকৃত বাচিকের শিক্ষা। করোনা-আবহের অভিশপ্ত পরিণতিতে হারাতে হয়েছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘কামালপাশা’–র অপ্রতিরোধ্য এই প্রবীণ শিল্পীকে। পাঁচ বছর আগে এই অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখে হঠাৎই তিনি চলে গিয়েছিলেন এক না ফেরার দেশে।
রবিবার বিকেল যোধপুর পার্কের ‘রাগ-অনুরাগ’ মঞ্চে শিল্পীকে নিয়ে স্মারক বক্তৃতা দেন পবিত্র সরকার। ‘প্রদীপ-অনির্বাণ’–এ একক নিবেদনে ছিলেন ড. শাহাদাত হোসেন নিপু, প্রদীপার্ঘ্য দাস, দেবাশিস মিত্র, প্রণব সাহা, রণবীর দত্ত, নন্দিতা কর, কাকলি সাহা। সঙ্গে নজর কাড়ল শিল্পী প্রদীপ ঘোষের তিন প্রিয় কবির কবিতার সমন্বয়ে একটি সুন্দর কবিতা পাঠের আসর ‘কবির পছন্দের শতবর্ষের তিন কবি’। নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় ছিলেন আশিসবরণ মল্লিক, সঞ্চিতা মিত্র, সায়ন্তনী দত্ত রায় ও সম্রাট দত্ত। সলিলের কবিতায় পিয়ালি মিত্র, মীরা গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রা চৌধুরী ও প্রতিপার্ঘ্য দাস। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পাঠ করেন সমাপ্তি রায় ও এষণা গুপ্ত। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রদীপ ঘোষের প্রিয় ছাত্রী সুলগ্না বসু।
অনুষ্ঠানে বারবার ফিরে এল শিল্পীর বর্ণাঢ্য জীবনের কথা। স্বাভাবিক ভাবেই। শৈশব কেটেছিল বাবার হাত ধরে। কখনও গ্রাম বাংলায়, কখনও ভিন রাজ্যের অরণ্য ঘেরা প্রকৃতির বুকে। ভোরবেলা বাড়িতে দুধ দিতে আসত যে লোকটি, তার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়তেন উন্মুক্ত সবুজ ঘেরা মাঠ আর নদীর তীরে। চিৎকার করে গলা সাধতেন। ওই বয়সেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কত লেখা তাঁর গলায় পূর্ণতা পেত গাছের অসংখ্য জানা অজানা পাখিদের শুনিয়ে। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও তিনি ঘরে বসে শুনিয়ে গিয়েছেন তাঁর প্রিয় কবিতা। মঞ্চে না হলেও ডিজিটাল মাধ্যমে। তাই তো তিনি বলতে পারতেন ‘আমি জন্মেছি কবিতার জন্য’।
‘কামালপাশা’ প্রদীপ ঘোষের জীবনের শ্রেষ্ঠ পাঠ বললেও কম বলা হয়। শিল্পীদের মধ্যে বদ্ধ ধারণা রয়েছে, গভীর অর্থবহ সব কবিতা তিনি এত সহজ সরল করে দিতে পারতেন, যা আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়। যেমন দেবতার গ্রাস, দূরের পাল্লা, বনলতা সেন তো আজও তারে বড় দৃষ্টান্ত।
এমন অবিশ্বাস্য অনেক কিছুই ছিল তাঁর জন্মগত প্রতিভায়। শুধু কবিতার জগৎ দূরে চলে যাবে এই আশঙ্কায় আকাশবাণীর ঘোষকের সরকারি চাকরি তিনি একবার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পাশাপাশি কবিতার কথা ভেবে ১৯৭০ সালে ম্যাক্স–ম্যুলার ভবনে বাংলার প্রথম চারদিনের কবিতা উৎসবে তিনিই হয়েছিলেন মধ্যমণি। সেই উৎসবে অন্নদাশঙ্কর রায়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী সব্যসাচীও উপস্থিত হয়েছিলেন। শিল্পী-কন্যা ড. পৃথা ঘোষের পরিকল্পনায় ও সম্রাট দত্ত, সুলগ্না বসুর পরিচালনায় বিশেষ অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল দুটি সংস্থার শিশুদের সমবেত উপস্থাপনা। প্রদীপ ঘোষ চিরকালই মনে করতেন, এরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাঁর অন্তরালেও সেই ধারা অব্যাহত।