হাওড়া পুরসভার মুখ্য প্রশাসকের পদ থেকে ইস্তাফা দিলেন সুজয় চক্রবর্তী। সূত্রের খবর, পদত্যাগপত্র ইতিমধ্যেই পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে রবিবার একটি সাংবাদিক বৈঠকে সুজয় চক্রবর্তী জানিয়েছেন। বর্তমানে হাওড়া পুরসভায় কোনও নির্বাচিত বোর্ড নেই। গত সাড়ে চার বছর ধরে প্রশাসকমণ্ডলীর নেতৃত্ব দিয়েছেন সুজয়বাবু।
এদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সুজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রীকে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। ইস্তফা গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছি।‘ তিনি আরও বলেন, ‘কারও নির্দেশ বা আদেশ নেই, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে আপাতত এই পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি।‘ তিনি জানান, ‘গত চার বছর এমন কোনও কাজ করেনি, যাতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।‘
দায়িত্ব থেকে সরে দাঁডা়নোর কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি কৃতজ্ঞটা জানিয়ে বলেন, ‘হাওড়ায় ৫-৬ লক্ষ মানুষ। দলের থেকে এই দায়িত্ব আমার কাছে বিশাল প্রাপ্তি। তবে পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত একেবারেই ব্যক্তিগত।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে হাওড়া পুরসভার তৃণমূল পরিচালিত বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর নবান্নের নির্দেশে পুরসভায় প্রশাসকমণ্ডলী তৈরি করা হয়। কয়েকজন সদস্যকে নিয়েই প্রশাসকমণ্ডলী চলে। এর আগে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায় প্রশাসকমণ্ডলীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে হাওড়ার বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক সুজয় চক্রবর্তীকে প্রশাসকমণ্ডলীতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মুখ্য প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বছর দেড়েক আগেও সুজয়বাবু একইভাবে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তখন পদত্যাগ না করলেও, আবারও ইচ্ছা প্রকাশ করে চিঠি দিলেন। গতবার পদত্যাগের ইচ্ছাপ্রকাশ করলেও রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের অনুরোধে তিনি পদত্যাগ করেননি। মুখ্য প্রশাসক জানান, সাড়ে চার বছর বোর্ড থাকাকালীন হাওড়া শহরে অনেক উন্নতি ঘটেছে। বিশেষত জমা জলের সমস্যা থেকে জঞ্জাল অপসারণের মতো সমস্যার সমাধান করা হয়।
একদিন আগেই হাওড়া পুরসভার ভাইস চেয়ারপার্সন পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন সৈকত চৌধুরী। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁর ওয়ার্ডেই পিছিয়ে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। শোনা যায়, সেই কারণেই দল তাঁকে এতদিন পর পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁর হাতে থাকা দপ্তর সেইসময় দেওয়া হয়েছিল সুজয় চক্রবর্তীর হাতে। এবার তিনিও নিজের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন।
এদিকে পদত্যাগ ঘিরে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কয়েকমাস আগেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছিলেন, ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বেশ কিছু পুরসভায় চেয়ারম্যান বদল হতে পারে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই হাওড়া পুরসভার চেয়ারম্যান সুজয় চক্রবর্তীর ইস্তফা দিলেন।
একুশের নির্বাচনের আগেও ঠিক শাসক দলের বেশকিছু পদাধিকারী ইস্তফা দিয়েছিল। বছর ঘুরলেই ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচন। এবারও ভোটের আগে ফের একের পর এক পদত্যাগ কি নতুন করে দলবদলের জল্পনা উস্কে দিচ্ছে? যদিও সুজয় চক্রবর্তী ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েছেন, তবে এনিয়ে জল্পনা বিস্তর। কালীঘাট সূত্রে খবর, এই ব্যাপারে আই-প্যাক সমীক্ষা শুরু করেছে। সংগঠনের স্তরেও সমীক্ষা চলছে। শেষ পর্যন্ত কৌশলের কোনও বদল না ঘটলে মাস খানেকের মধ্যে বেশ কিছু পুরসভায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান বদল করে নতুন মুখ আনা হতে পারে।
লোকসভা ভোটে বাংলায় কমবেশি ৭৪টি পুরসভায় পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। তার মধ্যে কিছু পুরসভায় ফলাফল ছিল খুবই খারাপ। শিলিগুড়ি পুরসভার ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩২টিতেই পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। তবে এ যাত্রায় ঠিক কতগুলো পুরসভায় চেয়ারম্যান বদল হবে তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। সেই সংখ্যাটা ৩০ থেকে ৪০ হতেই পারে। সন্দেহ নেই, পুরসভা স্তরে এই রদবদল তৃণমূলের অন্দরমহলে হইচই ফেলে দিতে পারে।
পুরসভায় রদবদল নিয়ে এখন ৩টি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এক, ঠিক কতগুলি পুরসভায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান বদল করা হবে। দুই, এ ব্যাপারে কি কোনও তালিকা প্রকাশ করবে তৃণমূল? তিন, বিধানসভা ভোটের আগে কেন পুরসভার চেয়ারম্যানদের বদল করছে তৃণমূল? বদলের কারণ কী হতে পারে?
তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা, প্রশাসনিক রিপোর্ট ও আই-প্যাকের রিপোর্ট অনুসারে, এই পুরসভাগুলির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কোথাও অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে কোথাও বা অদক্ষতার কারণে স্থানীয় স্তরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যত না অসন্তোষ তার চেয়ে বেশি অসন্তোষ এই সব স্থানীয় নেতাদের উপর।
তাই বিধানসভা ভোটের আগে এদের সরিয়ে দিলে স্থানীয় স্তরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা মোকাবিলা করা যাবে। এতে নিচু তলার কর্মীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। উত্তর চব্বিশ পরগনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পুরসভায় চেয়ারম্যান বদল করা হতে পারে বলে খবর। এখানে বেশ কিছু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্তরে অসন্তোষের পাশাপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ম বা চাকরি বিক্রির অভিযোগও রয়েছে।
উল্লেখ্য বিজয়া দশমীর পর এক ঘরোয়া আলোচনায় এই বদলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক সেদিনই যে প্রথমবার এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা নয়। চব্বিশের লোকসভা ভোটের পরও এ কথা জানিয়েছিলেন।
আগে ঠিক হয়েছিল ২০২৪ সালের মধ্যেই গোটা ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা হবে। শুধু পুরসভা নয় মন্ত্রিসভাতেও বড় রদবদল হবে। আরজি করের ঘটনা ও তার পরবর্তী কিছু ঘটনার জন্য সেই পরিকল্পনা তখনকার মতো ঘেঁটে যায়। এখন সেটাই হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে পুরসভায় বদল হলেও মন্ত্রিসভায় রদবদলের জন্য আর বিশেষ সময় নেই। তাই হবে বলেও মনে হয় না।