• ‘এসআইআর’ ভোটার তালিকা কী, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে কি এটি গুরুত্বপূর্ণ? কী বলছেন রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা...
    আজকাল | ২৮ অক্টোবর ২০২৫
  • গোপাল সাহা

    পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে শাসক-বিরোধী তরজা চরমে উঠেছে। আর ঠিক সেই সময় নির্বাচনকে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর মাধ্যমে ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া এই আগুনে ঘি ঢালার মত কাজ করেছে। একদিকে, কমিশনের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কারণে এসআইআর মাধ্যমে একাধিক পদক্ষেপ করেছে (যেমন,বিহার, তারপরেই হওয়ার সম্ভাবনা পশ্চিমবঙ্গে)। অন্যদিকে, কমিশনের এই পদক্ষেপ নিয়ে বাংলার শাসকদল-সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলি একাধিক অভিযোগ তুলেছে। এসআইআর পদ্ধতির স্বচ্ছতা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও কেন্দ্র গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের আরও অভিযোগ, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে তাদের ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করছে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। সংবিধান অনুযায়ী এসআইআর প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন করতে পারে, আইনে তার বিধান রয়েছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে রাজ্য তথা দেশের ভোটার তালিকায় কোনও ভুঁয়ো ভোটার বা ভূতুড়ে ভোটার বা একই নামের ভোটার দুই জায়গায় আছেন কি না অথবা মৃত মানুষের নাম উল্লেখ রয়েছে কি না সবটাই সংশোধন করার এক বিশেষ প্রক্রিয়া। যার ফলে ভোটার তালিকা একটি নির্ভুল ও সংশোধিত রূপ নেয় এবং ভোটদানের ক্ষেত্রে একটা স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা নির্বাচন কমিশনের কাছে তালিকার মাধ্যমে তৈরি হয়। 

    কিন্তু দেশের সব বিরোধী দল থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও বাংলা শাসকদলের ও শিক্ষিতসমাজের ও বিশেষজ্ঞদের মতে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে কেন্দ্র এই এসআইআর পদ্ধতিকে সামনে রেখে ঠারে-ঠোরে নাগরিকত্ব সংশোধন (সিএএ)-এর প্রক্রিয়াকে কার্যকর করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ। দেশের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীও এসআইআর পদ্ধতির অপব্যবহার নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। যদিও  কমিশন বারবার দাবি করেছে যে, স্বচ্ছতার সঙ্গে এসআইআর পদ্ধতি সম্পূর্ণ হবে। কিন্তু তা আদতে কি হচ্ছে সেটা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন? 

    বিহারে এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে একাধিক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিহারে প্রায় ৬৫ লক্ষেরও বেশি নাম বাদ পড়েছে। কমিশন জানিয়েছিল যে, অনুপ্রবেশকারীদের অধিকাংশই নাম বাদ গেছে। কিন্তু এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের মুখ্য আধিকারিক জ্ঞানেশ কুমার কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। যার ফলে বিতর্ক আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে তবে কি নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র সরকার দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে এবং একই সঙ্গে কেন্দ্র এই পদ্ধতি দ্বারা নিজেদের সরকারের রাজ্য স্তরে আধিপত্য বিস্তারের প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে! 

    এক নজরে এসআইআর ভোটার তালিকা

    স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) দ্বারা পরিচালিত একটি সংশোধিত ভোটার তালিকার আপডেট প্রক্রিয়া। এটি কোনও রুটিন সংশোধন নয়, রাজ্যে ২৫ বছর পর এসআইআর হতে চলেছে। বুথ লেভেল অফিসাররা (বিএলও) প্রতিটি বাড়ি ঘুরে ভোটারের বিবরণ যাচাই করে, অসঙ্গতি দূর করবে এবং তালিকার অখণ্ডতা নিশ্চিত করে। এটি সাধারণত বর্তমান তালিকাকে পুরনো মানদণ্ডের (যেমন, পশ্চিমবঙ্গে ২০০২-এর তালিকা) সঙ্গে তুলনা করে এবং ভোটারদের আধার, রেশন কার্ড বা জন্ম শংসাপত্রের মতো দলিল প্রদান করতে হয় যাতে যোগ্যতা নিশ্চিত হয়। এই প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হল, বড় নির্বাচনের আগে একটি ‘পরিষ্কার, ত্রুটিমুক্ত’ ভোটার তালিকা তৈরি করা।

    পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

    বিহারে শেষ বার এসআইআর হয়েছিল ২০০৩ সালে। কমিশন ২০২৫-এর মাঝামাঝি বিহারে এসআইআর শুরু করে। এটি ২৪৩ কেন্দ্রে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের নথি যাচাই করে। বিহারের ভোটার তালিকায় ভূতুড়ে ভোটার, একাধিক জায়গায় নাম, মৃত ভোটারের নাম ছিল ভোটার তালিকায়। এসআইআর-এর মাধ্যমে সে সব সংশোধন করে, শুধুমাত্র সত্যিকারের ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেছে। বিহারে প্রায় ৬৫ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছিল এসআইআর প্রক্রিয়ার পর। বিরোধী দলগুলি (যেমন, আরজেডি, কংগ্রেস) এটিকে প্রান্তিক ভোটারদের (যেমন, দলিত এবং মুসলিম) অধিকারহরণের হাতিয়ার বলে সমালোচনা করেছিল। যে সকল নথি চাওয়া হয়েছে তা অনেকের কাছে নেই বলে অভিযোগ তুলেছিল দলগুলি। এছাড়া উদ্বেগ রয়েছে যে, এটি ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি) প্রাথমিক প্রক্রিয়া হতে পারে। 

    পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১১টি রাজ্যে ফেজ-২ এসআইআর চালু করতে চলেছে কমিশন। প্রাথমিক ভোটার ম্যাপিং দেখা গিয়েছে বর্তমান নামের প্রায় ৪৫ শতাংশ ২০০২-এর তালিকার সঙ্গে মিলছে না। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস সংশোধন দাবি করেছে, যার মধ্যে ২০০২-এর পরের তালিকা ব্যবহার করে যাচাই করা যাতে ব্যাপক নাম বাদ দেওয়া এড়ানো যায়। রাজ্যে বিজেপির বরাবরের অভিযোগ, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নাম দিয়ে ভোটার তালিকা ফুলিয়ে তোলা হয়েছে। এসআইআর-এর মাধ্যমে তালিকা সংশোধনের ফলে প্রকৃত ভোটারের নাম প্রতিফলিত হবে। যা ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যক বলে মনে করে কমিশন।

    এসআইআর নিয়ে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, “ভোটার তালিকায় সংশোধন নির্বাচন কমিশন করতেই পারে। অতীতে করেছে, ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই করবে। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে এবারে এসআইআর বা স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিউ নিয়ে এত বিতর্ক কেন? কেন মামলা, কেন এত প্রতিবাদ? একটা প্রথম কারণ অবশ্যই স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিউয়ের লক্ষ্য নিয়ে। প্রথমে বিহারে হল, তারপরে পশ্চিমবঙ্গে হওয়ার আগে থেকেই এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে যেন ভোটার তালিকায় সংশোধন নয়, ভোটারদের নাম বাদ দেওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য। এই বিষয়ে বেশি কথা বলছেন কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি র রাজনৈতিক নেতারা। তখনই মনে হচ্ছে, এই এসআইর-এর পিছনে আসল উদ্দেশ্য প্রশাসনিক না রাজনৈতিক? আসলে কি প্রান্তিক অর্থাৎ দলিত, মুসলিম বা মহিলাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে? সেই উদ্দেশ্য নিয়েই বিতর্ক, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিবাদ, নাগরিক সমাজের বিক্ষোভ| নির্বাচন কমিশনের কোনও পদক্ষেপ বা ভুল সিদ্ধান্ত যেন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা না তৈরি করে, ভারতবর্ষে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি না তৈরি করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী বাংলাদেশে ভোটে কারচুপির অভিযোগকেই কেন্দ্র করে তুলকালাম ঘটে যায়। শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।”

    সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী এসআইআর নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেন, “নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা এবং প্রত্যেক মানুষের যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায় তার গ্যারান্টি দেওয়া। নির্বাচন কমিশন এসআইআর-এর মাধ্যমে নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করবে। যেমন ২০০২ সালে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। দিনের আলোয় পরিষ্কার ভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। কিন্তু কমিশন সেটা না করে পুরো ব্যাপারটা গোপনে গোপনে করতে চাইল। যেটা কমিশনের কাজ নয় অর্থাৎ নাগরিকত্ব যাচাইয়ে তাদের কোনও এক্তিয়ার নেই, এই কাজ সম্পূর্ণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের। আর এ জায়গায় খুব সহজেই বলা যায়, তারা নিজেরাই নিজেদের অপরাধের সঙ্গে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ফেলল। মূলত, বিজেপির ইচ্ছায় জেনুইন ভোটার তালিকা বাতিল করা, আর তৃণমূলের আগ্রহে মৃত মানুষের নাম রেখে দেওয়া এবং কোন ব্যক্তির নাম ডবল এন্ট্রি বা ট্রিপিল এন্ট্রি কিংবা ভূতুড়ে ভোটার তালিকা রক্ষা করা। যেখানে আপত্তি আসবেই এবং মানুষের বিরোধীতাও আসবে। কমিশন কোনও অবস্থাতেই নাগরিকত্ব সংশোধনের কাজ করতে পারে না। নির্বাচন কমিশন এই সমস্ত কাজে যুক্ত হয়েছে কেন?" 

    সুজন আরও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন পাগলের প্রলাপের মতো বলছেন তার কোনও মানে নেই। তাদেরই তো হাত ধরে বিজেপি বাংলায় এসেছে। বাংলায় আধিপত্য গড়ার যে প্রচেষ্টা বিজেপির তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ মমতা ব্যানার্জির, তিনি বাংলায় আসার পরেই তো বিজেপির এত বার বারন্ত, বিজেপি তাদের লম্পো জম্প বাড়াতে পেরেছে। পশ্চিমবঙ্গে তাদের কোনদিন পরিবেশ ছিল না, এটা এনেছেই মমতা ব্যানার্জি। কাজেই তার কথা শুনে লাভ কি আছে? তৃণমূলের মানুষ হয়ে বিজেপিতে পাঠিয়ে বিজেপিকে বড় করছেন। প্রয়োজন মত বিজেপিকে পাঠাচ্ছেন আবার প্রয়োজনে বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফিরিয়ে আনছেন, যেমন মুকুল রায়কে দেখুন, শোভন চ্যাটার্জিকে দেখুন।”

    তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র অনির্বাণ ব্যানার্জি আজকাল ডট ইন-এর মুখোমুখি হয়ে বলেন, “নির্বাচন কমিশন এসআইআর করছে করুক, এসআইআর আইনি প্রভিশন রয়েছে, তা নিয়ে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা যেভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছে বা হরণ করা হয়েছে এবং কেন্দ্র যেভাবে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে রাজনীতি করছেন তাতে ঘোরোতর বিরোধিতা রয়েছে আমাদের।  মূলত যে আইন ছিল, এই এসআইআর-এর ক্ষেত্রে তিনজন থাকবেন, সরকারের পক্ষে একজন, বিরোধী দলনেতার পক্ষের একজন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পক্ষে একজন। সেখানে কেন্দ্র নতুন করে অর্ডিন্যান্স এনে সরকারের পক্ষে দু’জন এবং বিরোধী দলের একজনকে রাখে।”

    তিনি আর বলেন, "নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের ভূমিকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে কিন্তু তারা কোন উত্তর দিতে পারেনি। অমিত শাহ নিজে বিহারে গিয়ে বলেছিলেন লক্ষ লক্ষ লোকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে যারা অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু যখন জ্ঞানেশ কুমারকে প্রশ্ন করা হয়েছে কত জন অনুপ্রবেশকারীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তখন কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। এই আবহে পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর করার উদ্দেশ্য বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। তাই নিরপেক্ষহীন এই ধরনের এসআইআর আমরা চাই না।”

    তৃণমূল মুখপাত্র অনির্বাণ সুজন চক্রবর্তী করা মন্তব্যে কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলেন, “সুজনবাবু দীর্ঘকাল ধরে বিলাপ বকে যাচ্ছেন। তিনি নিজেদের জায়গাটাকে স্থির করুন। সুজন বাবুরা তৃণমূলকে বারবার বলছে বিজেপি কে বাংলায় তৃণমূল এনেছে যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নি, তাহলে বাংলায় বিরোধী দলের আসনটা অর্থাৎ তকমাটা কে উপহার দিয়েছে। তাদের নিজেদের ২৯ শতাংশ ভোট কী করে বিজেপির ঝুলিতে চলে গেল তার উত্তর দেবেন সুজনবাবুরা। ২০১৯ সালে তাদের ২৯ শতাংশ ভোট কমে গেল আর বিজেপির বেড়ে গেল। অর্থাৎ এখানে বলা যায় যে ভোটব্যাঙ্কের ওপরে বিজেপি আজকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বাংলায় সেটা পুরোপুরি সিপিএমের দেওয়া উপহার কিংবা তারা সমর্পণ করে বসে আছেন ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সে যাই হোক। সেটা এখনও ফিরিয়ে আনার কোনও চেষ্টাই তারা করছেন না তার উত্তরটা দিন আগে।”
  • Link to this news (আজকাল)