বুড়িমা সাজছেন ১৫ কেজি সোনার গয়নায়, থাকবে লক্ষ ভক্তের ভোগ
বর্তমান | ২৮ অক্টোবর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, কৃষ্ণনগর: আলো, ভক্তি আর ঐতিহ্যে সাজছে কৃষ্ণনগর শহর। আসন্ন জগদ্ধাত্রী পুজোয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে সেই চিরচেনা, চিরজাগ্রত দেবী— চাষাপাড়ার বুড়িমা। আড়াই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই পুজো শহরের ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আর এবছর সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন ইতিহাস— প্রায় ১৫ কেজি সোনার গয়নায় সেজে উঠবেন বুড়িমা। টাকার হিসেবে যার মূল্য কয়েক কোটি। ভক্তদের দেওয়া গয়নাতেই ভূষিত হন কৃষ্ণনগরের বুড়িমা। পুজোর দিন দেবীমূর্তি সোনায় গয়নায় মোড়া থাকে। শহরের মানুষ বিশ্বাস করেন, এই গয়নার প্রতিটি অংশে মিশে আছে তাদের প্রার্থনা, বিশ্বাস ও আশীর্বাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। ২৫৩ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে আজও এই পুজো কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি কৃষ্ণনগরের মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা এক সাংস্কৃতিক উত্সব।
শুধু সজ্জা নয়, পুজো ঘিরে আয়োজনও ব্যাপক। পুজো কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, চলতি বছরে লক্ষাধিক মানুষকে ভোগ বিতরণ করা হবে। দেবী দর্শনে যেন মানুষের ঢল নামে। সকাল থেকেই কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় উপচে পড়ে ভিড়। পুজোর দিনগুলিতে মন্দির প্রাঙ্গণে পা রাখার জায়গা থাকে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে পুষ্পাঞ্জলি, আরতির ধ্বনি, ভক্তির স্রোত। প্রশাসনেরও থাকে তৎপরতা— ভিড় সামলানো, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আর সর্বোপরি শহরের গতি সচল রাখা।
চাষাপাড়া বারোয়ারির সম্পাদক গৌতম ঘোষ বলেন, লক্ষাধিক মানুষ ভক্তিভরে বুড়িমাকে দেখতে আসেন। তাঁর পুজো নিয়ে আলাদারকম ভাবে ভাবার কোনও জায়গা নেই। এবারও আমরা লক্ষাধিক মানুষকে ভোগ দেব। চার-পাঁচদিন ধরে আমাদের চুল্লি জ্বলবে। প্রশাসনও আমাদের পুজো নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করে। দেবীর জন্য এবার বিশেষ গয়নাও বানানো হচ্ছে।
এবছর ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় দেবী সাজানোর মধ্য দিয়ে শুরু হবে পুজোর মূল পর্ব। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৫টা ৪৪ মিনিটে সপ্তমীর পুজো শুরু হবে। সকাল ৯টা ৩০মিনিটে পুষ্পাঞ্জলি, ১০টা ৩০ মিনিটে অষ্টমীর পুজো, আর দুপুর ১২টার সময়ে অষ্টমীর অঞ্জলি। নবমীর পুজো হবে দুপুর ১টায়, আড়াইটে নাগাদ নবমীর অঞ্জলি ও ৩টেয় বলিদান। বিকেল ৪টেয় আরতি ও সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হবে মহা আরতি।
কিন্তু পুজোর আসল জৌলুস যেন ভাসান পর্বে। নিরঞ্জনের দিনে বুড়িমার শোভাযাত্রা কৃষ্ণনগরের আকাশকে কাঁপিয়ে তোলে। শত শত ঢাকির বাদ্য, হাজারো মানুষের স্লোগান— জয় বুড়িমা! আর তার সঙ্গে ভক্তদের উল্লাসে শহর যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। নিরঞ্জনের সময়ে কদমতলা ঘাটে উপচে পড়া ভিড় চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। শহরের জগদ্ধাত্রী পুজোর শেষ নিরঞ্জনও হয় বুড়িমারই, যেন তিনিই কৃষ্ণনগরের অভিভাবক।
এই পুজো ঘিরে রয়েছে বহু জনশ্রুতি। ইতিহাস বলছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই প্রজারা মিলিত হয়ে শুরু করেন চাষাপাড়ার এই পুজো। কেউ কেউ বলেন, রাজাকে স্বপ্নে দেবী স্বয়ং আদেশ দিয়েছিলেন— চাষাপাড়ার লেঠেলরাই যেন এই পুজোর দায়িত্ব নেন। সেই থেকেই শুরু বুড়িমার পুজো। প্রথমে তাঁকে সবাই চিনতেন ‘চাষা মা’ নামে। পরে সময়ের স্রোতে তিনি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় ‘বুড়িমা’।