প্রতি বছরের মতো এ বারও আলোর উৎসব বিতর্ক এড়াতে পারল না। সৌজন্যে, শব্দবাজি। আর তা ঘিরে হল অন্য এক সংঘাত। যার রেশ ছড়াল বহু দূর।
এখানে একটা কথা পরিষ্কার বলা ভাল, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনও মানুষই শব্দবাজি সমর্থন করেন না। এই বাজি যে কী পরিমাণে দূষণ ছড়ায়, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে। কিন্তু মজা হল, যাঁরা এই অপকর্ম করেন, তাঁরা যে আখেরে নিজেদেরও ক্ষতি করছেন, তা তাঁদের বোঝাবে কে? ফলে, এ বারের কালীপুজোর রাতে শিলিগুড়িতে ‘একিউআই’ মাত্রা ছিল ২১২। কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে ১৮৪, জলপাইগুড়িতে ১৮২। এই ছোট্ট পরিসংখ্যান বলে দেয়, সারা রাজ্যে তা হলে কী অবস্থা হয়েছিল!
শব্দবাজির তাণ্ডবে বয়স্ক, রোগী, শিশুরা যে সমস্যায় ভুগেছে, তার থেকে পরিত্রাণের অভিমুখ কেউ দেখাতে পারেননি। তথাকথিত সুসভ্য মানুষেরই যেখানে এই দশা, সেখানে পশুপাখিদের অবস্থা কী হতে পারে সেটাও বোঝা যায়। কিন্তু উৎসবের বেপরোয়া আনন্দে আমরা সব ভুলেই গিয়েছিলাম। ফলে, কলকাতায় শব্দদানবের হাত থেকে বাঁচতে পথকুকুরকে পাতালরেলে উঠতে দেখেও আমাদের হুঁশ ফেরেনি। বিভিন্ন পরিবারের পোষ্যদের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। তবে শুধু বাজি নয়। প্রবল আওয়াজের ডিজে-র অত্যাচারও প্রমাণ করে, ভক্তি ও শ্রদ্ধার চেয়ে এমন বাঁধনহারা আনন্দই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আর এই ব্যাপারে পিছিয়ে নেই কোনও গোষ্ঠীই।
কিন্তু তাই বলে কি সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে? না, সে রকম নিশ্চয়ই নয়। যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিয়ম ও সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, সেখানে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু আমরা নিয়ম তৈরি করি সম্ভবত ভাঙার জন্যই। আর সেটা করে যে আত্মতৃপ্তি অনুভব করি, তার তুলনা হয় না। ফলে কীসের নিয়ম, কীসের সময়সীমা! সারা রাত ধরে তাণ্ডব চলেছে। যাঁরা এরকম করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হঠকারী আচরণ করেন, সেটাও মানা যায় না। কোচবিহারে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত ব্যাপার সেটিই প্রমাণ করে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠে আসে, যেখানে সরকারি কর্তার বাড়ির আশপাশেই এই অবস্থা, সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী! তাঁদের না আছে প্রশাসনিক সমর্থন, না নিজস্ব বাহিনী। তারা কোথায় যাবেন? কাকে বলবেন? প্রশ্ন জাগছে, এত দিন ধরে নাকের ডগায় শব্দবাজি রমরম করে বিক্রি হলেও, প্রশাসন সে দিকে নজর দেয়নি কেন? কোথা থেকে এল এত শব্দবাজি? এ সব দেখার দায়িত্ব তো প্রশাসনের। যদি সর্বময় কর্তা নিজের বাংলোতেই বাজি ছোঁড়া বন্ধ করতে না পারেন, যদি তাঁর নিজেরই নিরাপত্তা না থাকে, তা হলে তো যে কেউ, যে কোনও জায়গায়, যা খুশি করবে।
উপোস করে, অঞ্জলি দিয়ে, মন্ত্রোচ্চারণ করে পুজো করলেই হয় না। সমস্ত প্রক্রিয়া আত্মস্থ করতে হয়। তা হলেই বোঝা যায়, পুজোর গভীরে লুকিয়ে আছে প্রকৃতিরই উপাসনা। শব্দবাজি সেই প্রকৃতিকেই আঘাত হানছে। অবিলম্বে তা বন্ধ হওয়া উচিত এবং সে জন্য প্রয়োজন প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের একসঙ্গে কাজ করা।