জাতীয় নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া ঘোষণা করার পর মঙ্গলবার সর্বদল বৈঠক হল রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) মনোজকুমার আগরওয়ালের দফতরে। বিকেল ৪টে থেকে দীর্ঘ ক্ষণের বৈঠকে যুক্তি-তর্ক চলল। আধার কার্ড এবং এনুমারেশন ফর্ম ইস্যুতে বিবাদও হল। পরে সাংবাদিক বৈঠকে একে অপরকে বিঁধলেন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। সব কিছু শুনে সিইও জানালেন, তিনি এখানে পোস্ট অফিসের ভূমিকায়।
আগামী বছরেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। তার প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে এসআইআর নিয়ে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতরে সর্বদল বৈঠক হল মঙ্গলবার।
এসআইআর নিয়ে তৃণমূলের বক্তব্য:
রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের দাবি, এসআইআর (ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন) নিয়ে প্রচুর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে আত্মহত্যা করছেন। তার দায় কমিশনকেই নিতে হবে। তিনি জানান, ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডে দিলীপকুমার শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন। এর দায় কমিশনকে নিতে হবে। ২০০২ সালে ২ বছর ধরে এসআইআর শেষ হয়েছিল। এখন কেন পুরো প্রক্রিয়া দুই-আড়াই মাসে শেষ করতে চাইছে তারা? কাদের খুশি করতে কমিশন এমনটা করছে? বৈঠকের পরে মন্ত্রী বলেন, ‘‘কমিশনের সকলকে মা-বাবার জন্মের শংসাপত্র জমা দিতে হবে। তার পরে সাধারণ মানুষকে বলবেন। কমিশনের অধিকার নেই কারও ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার।’’ তাঁর দাবি, এসআইআর পূর্বপরিকল্পিত। সিএএএ, এনআরসি-র ক্যাম্প শুরু হয়েছে। ‘বিশাল খেলা’ চলছে। প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ করবেন তাঁরা।
রাজ্যের শাসকদলের তরফে বৈঠকে ছিলেন মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমও। তিনি জানান, বাংলার এক জন বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেলেই প্রতিবাদে সরব হবে তৃণমূল। তাঁর কথায়, ‘‘এতগুলো ভোট হয়েছে। নাগরিকেরা যদি ভোট না-দিয়ে থাকেন, তা-হলে প্রধানমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হবে।’’ অভিযোগের সুরে তিনি জানান, হঠাৎ এলাকায় এলাকায় সিএসএস ক্যাম্প হচ্ছে। কমিশন-বিজেপি ভাই-ভাই। পরিযায়ী পরিবারের লোকেরা সই করলে মান্যতা দেবে বলেছে। তার ‘ম্যাপিং’ সব রাজনৈতিক দলকে দিতে হবে।
এসআইআর নিয়ে বৈঠকে বিজেপি:
কমিশনে সর্বদল বৈঠকে বিজেপির তরফে উপস্থিত ছিলেন শিশির বাজোরিয়া। বৈঠকের পরে তিনি বলেন, ‘‘খুশি হলাম যে, গতকাল (মঙ্গলবার) থেকে এসআইআর নিয়ে তৃণমূলের অবস্থান পাল্টে গিয়েছে। এখন তারা বলছে, নির্ভুল ভোটারের কথা। বলছে, এক জন বৈধ ভোটারও যেন বাদ না যান। এর আগে ওরাই বলেছিল, এসআইআরের বিরোধিতা করে পাঁচ লক্ষ লোক নিয়ে দিল্লি যাবে।’’ ফিরহাদ, অরূপের দাবির প্রেক্ষিতে বিজেপি নেতা বৈঠকে অভিযোগ করেন, আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকলে সে জন্য তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী দায়ী। কারণ, ভুল কথা বলে মানুষকে ভয় দেখানো হয়েছে। প্রশান্ত কিশোরের নাম দুই জায়গায় (বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায়) কী ভাবে এল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। জানান, ৬ হাজার ভুল নাম বিএলও থেকেই হয়েছে। এসআইআর-কে স্বাগত জানাচ্ছে বিজেপি।
এসআইআর নিয়ে বৈঠকে বামেরা:
সর্বদল বৈঠকে বামেদের তরফে সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, বৈঠক থেকে তাঁর মনে হয়েছে যে, এসআইআর নিয়ে সিইও তৈরিই নন! তিনি নাকি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করাই কমিশনের কাজ। কিন্তু সুজনের প্রশ্ন, কমিশন থেকে ১২টি নথির কথা বলা হচ্ছে। বাকি ১১টি নথি যে নাগরিকত্বের প্রমাণ, এটা কী ভাবে বলা হচ্ছে? নাগরিকত্ব ঠিক করার অধিকার কমিশনকে কে দিয়েছে? তিনি বলেন, ‘‘২০০২ সালের তালিকা কেন ধরা হল? কে ঠিক করল সেটা? ভুয়ো ভোটারদের নাম কমিশন পায় না অথচ, পাড়ার ছেলেরা পায়!’’
রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের বক্তব্যের পর রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজকুমার জানান, সকলের সহযোগিতা কাম্য। বুথভিত্তিক যত বেশি এজেন্ট নিয়োগ করা যায়, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলিকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি এ-ও জানান, এ ছাড়াও ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন নিয়ে কারও অভিযোগ বা বক্তব্য থাকলে লিখিত আকারে তাঁকে জমা দিতে হবে। তিনি নির্বাচন কমিশনের সদর দফতরে পাঠাবেন। তখন কংগ্রেসের তরফে বলা হয়, তিনি কি পোস্ট অফিসের ভূমিকায়? জবাবে মনোজকুমার ‘হ্যাঁ’ বলেন। তিনি এখানে পোস্ট অফিসের ভূমিকাই পালন করবেন বলে জানিয়েছেন। মনোজকুমার জানিয়েছেন, আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিএলও-দের ট্রেনিং হবে। প্রত্যেক ভোটারের কিউআর কোড তৈরি হবে। তার পরে প্রিন্ট করা হবে। ৭.৬৬ কোটি ভোটার রয়েছে বাংলায়। প্রত্যেক ভোটারের বাড়িতে বিএলও যাবেন।