• এসআইআর আতঙ্কে আত্মঘাতী, পানিহাটিতে চাঞ্চল্য, সুইসাইড নোট লিখে গলায় দড়ি
    বর্তমান | ২৯ অক্টোবর ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, বরানগর: ‘এসআইআর হবে। বাদ যাবে এক কোটিরও বেশি ভোটারের নাম। যাদের নাম বাদ যাবে তাদের ছুড়ে ফেলা হবে কাঁটাতারের ওপারে।’ গেরুয়া শিবিরের লাগাতার হুঁশিয়ারিতে আতঙ্ক গ্রাস করেছিল পানিহাটি পুরসভার আগরপাড়া এলাকার প্রৌঢ় প্রদীপ করকে (৫৭)। সোমবার বিকেলে এসআইআর ঘোষণা হতেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলছিলেন না। বন্ধুদের বলেছিলেন, এসআইআরের পর কি এনআরসি হবে? ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে? এই আতঙ্কই কেড়ে নিল প্রৌঢ়ের প্রাণ। মঙ্গলবার সকালে বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে উদ্ধার হল তাঁর ঝুলন্ত দেহ। সঙ্গে মিলল সুইসাইড নোট। তাতে লেখা, ‘আমার মৃত্যুর জন্য এনআরসি দায়ী’। 

    মঙ্গলবারই শুরু হয়ে গিয়েছে এসআইআর প্রক্রিয়া। রাজ্যের প্রত্যেক প্রান্তে চর্চা এবং আতঙ্ক একটাই—কাগজ দেখাতে হবে। না হলে চলে যাবে নাগরিকত্ব। কিন্তু এসআইআরে কি নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারে কমিশন? তাহলে কি এরপর এনআরসি? প্রদীপ করের মৃত্যু আগুনের মতো এই আতঙ্কই ছড়িয়ে দিয়েছে। শোকের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ক্ষোভ। এদিন দুপুরে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন বারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মুরলিধর শর্মা। পরে  মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, বিধায়ক নির্মল ঘোষ, পানিহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান সোমনাথ দে সহ অন্যান্য তৃণমূল নেতৃত্বও হাজির হন। প্রদীপবাবুর জন্ম পলাশীতে। গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি পানিহাটির আগরপাড়া এলাকায় থাকতেন। ভাই তপন কর ও ভ্রাতৃবধূ মৌসুমির সঙ্গে। প্রথমদিকে ভাড়া বাড়ি। পরে ফ্ল্যাট কিনে চলে আসেন পানিহাটি পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আগরপাড়ার মহাজাতি নগরের আবাসনে। ঊষুমপুর বটতলায় তাঁদের বেডিংয়ের দোকান রয়েছে। প্রদীপবাবু প্রতিদিন সকালে সাড়ে ৮টা-৯টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। মঙ্গলবার সকালে ৯টার পরও তিনি ঘর থেকে না বের হওয়ায় মৌসুমিদেবীর সন্দেহ হয়। তিনি বারবার দরজায় ধাক্কা দিলেও সাড়া পাননি। পরে তিনি স্থানীয়দের বিষয়টি জানান। স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা কাউন্সিলারের স্বামী জয়দীপ ভৌমিক জানতে পেরে খড়দহ থানায় জানান। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে দরজা ভেঙে প্রদীপবাবুর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। পাশে একটি আধখোলা ডায়েরি। তার পাতা উলটাতেই হাতে আসে সুইসাইড নোট। 

    পুলিশ জেনেছে, সোমবার রাতে দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পরই অসুস্থ বোধ করছিলেন প্রদীপবাবু। মৌসুমিকে এসআইআর নিয়ে প্রশ্নও করেছিলেন। তারপর সামান্য কিছু খেয়েই নিজের ঘরে শুতে চলে যান। মৃতের ভাই তপনবাবুও প্রৌঢ়। কয়েক মাস আগে তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়েছে। সাত বছরের বড় দাদার এই মর্মান্তিক পরিণতিতে তিনি শোকে মূহ্যমান। বলেন, ‘দাদা এনআরসি নিয়ে চিন্তা করত সব সময়। এসআইআর ঘোষণা হবে, তাতে কাগজ দেখাতে হবে, এসব শুনে আরও ভেঙে পড়েছিলেন। গতকাল এসআইআর নিয়েও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তারপর একেবারে চুপচাপ হয়ে যান। আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো শারীরিক কোনও সমস্যা। কিন্তু এভাবে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবেন, আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। 

    পুলিশ কমিশনার মুরলিধর শর্মা বলেন, ‘মৃতদেহের পাশ থেকে সুইসাইড নোট উদ্ধার হয়েছে। তাতে এনআরসি নিয়ে ভয়ের উল্লেখ আছে। সবদিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভোটার লিস্টে নাম রয়েছে, ভোটও দিচ্ছেন এমন কাউকে এসআইআরের নামে তালিকা থেকে বাদ দিতে দেব না। কেউ যদি ওপার বাংলা থেকে এদেশে এসেও থাকেন, তার জন্য নির্দিষ্ট আইন আছে। সেই আইন লঙ্ঘন করার এক্তিয়ার কারও নেই। এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন আরও তীব্র হবে।’ বিজেপির অমিত মালব্যের বক্তব্য, ‘প্রদীপ করের মর্মান্তিক মৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া উচিত। আত্মহত্যার কারণ কেবল আইন এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলি দ্বারাই নির্ধারণ করা যেতে পারে। রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে নয়।’
  • Link to this news (বর্তমান)