• শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে চাননি ঋত্বিক
    বর্তমান | ২৯ অক্টোবর ২০২৫
  • ১৯৭৩ সাল। এক বিশেষ মিশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার রওনা দিল দিল্লি থেকে। গন্তব্য সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। কোনও কূটনৈতিক মিশন নয়, হেলিকপ্টারটি যাচ্ছিল বাংলাদেশে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া এক চলচ্চিত্র স্রষ্টাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে। তাঁর নাম ঋত্বিক ঘটক। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির শ্যুটিং করছিলেন ঋত্বিক। শ্যুটিংয়ের শেষ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হচ্ছিল সেদিন। নায়িকা বালির উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। জীবনদীপ নিভে গেল তাঁর। এদিকে ‘কাট’ বলার অপেক্ষা, তারপর ঋত্বিকও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। মুখ থেকে রক্ত — টিউবারক্যুলসিস! মারণ ব্যধি। কলকাতা থেকে রওনা দিলেন তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটক। অসুস্থ ঋত্বিককে কলকাতায় নিয়ে এসে ভর্তি করা হল কলকাতা মেডিকেল কলেজে। ছুটে এলেন উত্তমকুমার। কপর্দকহীন ঋত্বিকের চিকিৎসার জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সংসদ দিল ১ হাজার টাকা।

    তিতাসের পোস্ট প্রোডাকশনে থাকতে পারেননি ঋত্বিক। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন, সংশয়ে ভুগেছেন বাংলাদেশে ছবিটির পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ যথাযথ হবে কি না, তা নিয়ে। ছবিটির এডিটিং থেকে ডাবিং সবই হয়েছিল তাঁর বাংলাদেশি সহকারীদের তত্ত্বাবধানে। সে নিয়ে পরে আফশোসও করেছেন। সেই ছবি দিয়েই এ বছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ঋত্বিক ঘটকের রেট্রোস্পেকটিভ শুরু হবে। এছাড়াও দেখানো হবে তাঁর পরিচালিত ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’। আগামী ৪ নভেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ করবেন এই অগ্নিবর্ষী শিল্পস্রষ্টা। সেই উপলক্ষ্যেই এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। ছবি দেখানোর পাশাপাশি পরিচালককে নিয়ে একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়েছে।

    ২০১০ সালে হলিউডের পরিচালক মার্টিন স্করসেসির ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা প্রজেক্ট’-এ তিতাস রেস্টোর করা হয়। সেই রেস্টোর্ড ভার্সানটিই দেখানো হবে কলকাতায়। কান ফেস্টিভ্যালে তিতাসের রেস্টোর্ড ভার্সান দেখানো উপলক্ষ্যে ঋত্বিক সম্বন্ধে স্করসেসি বলেছিলেন, ‘হি হ্যাড আ এক্সট্রিম রিফাইন্ড ভিশন অব সিনেমা, অ্যান্ড হিজ পিকচার্স ওয়্যার বোথ ভিজ্যুয়ালি অ্যান্ড থিমেটিক্যালি ডেন্স অ্যান্ড লেয়ার্ড’। সেই ঋত্বিকই আবার এক সময়ে বলেছিলেন, সিনেমার প্রেমে আমি পড়িনি মশাই। যেদিন এর থেকে বেটার কোনও মিডিয়াম আসবে, সেদিন সিনেমার মুখে লাথি মেরে চলে যাব। আসলে ঋত্বিক কোনওদিনই ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমৃত্যু কমিউনিস্ট আদর্শে অবিচল ঋত্বিক শিল্পকে কোলবালিশ করে বাঁচতে চাননি। সিনেমা ছিল তাঁর কাছে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রচারের হাতিয়ার। তবে তা করতে গিয়ে কখনওই নিছক ‘প্রোপাগান্ডা’ করেননি। সমাজের অব্যবস্থাগুলি শিল্পসম্মত ভাবে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। শিল্পী সৎ হবেন, মানুষের সঙ্গে নাড়ির যোগ রেখে চলবেন, এমনই ছিল তাঁর মত। সেই আদর্শ তিনি চারিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে তাঁর প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে। যাঁদের মধ্যে অন্যতম, মনি কাউল, কুমার সাহানি, আদুর গোপালকৃষ্ণন প্রমুখ। আদুর আসছেন কলকাতায়। তিনি বলবেন তাঁর প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে।
  • Link to this news (বর্তমান)