পানিহাটির পর দিনহাটায় এসআইআর আতঙ্ক! ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধর আত্মহত্যার চেষ্টা
দৈনিক স্টেটসম্যান | ৩০ অক্টোবর ২০২৫
দক্ষিণবঙ্গের পর এবার উত্তরবঙ্গে। উত্তর চব্বিশ পরগনার আগরপাড়ার পর এবার কোচবিহারের দিনহাটায় এসআইআর আতঙ্ক। ভোটার তালিকায় নাম বাদ যাওয়ার ভয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা কোচবিহারের দিনহাটার খায়রুল শেখের। বয়স ৬৫ বছর। পেশায় কৃষক। দিনহাটার বুড়িহাট ২ পঞ্চায়েতের জিৎপুরের বাসিন্দা। স্থানীয় সূত্রে খবর, বুধবার সকালে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বৃদ্ধ। অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে দিনহাটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে কোচবিহার এমজেএন হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানেই খায়রুল শেখের চিকিৎসা চলছে।
সোমবার বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর ঘোষণা করেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার। এরপরই আতঙ্কে আত্মহত্যা করেন উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির বাসিন্দা প্রদীপ কর। উদ্ধার হওয়া ‘সুইসাইড নোটে’ এসআইআরকে দায়ী করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। যা নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজ্য রাজনীতি। এই ঘটনায় বিজেপিকে নিশানা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূল নেতৃত্ব। তার মধ্যেই এ বার কোচবিহারে আত্মহত্যার চেষ্টা এক বৃদ্ধের।
খায়রুল শেখের পরিবারের অভিযোগ, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর সঠিক নাম খায়রুল শেখ লেখা ছিল। এসআইআর চালু হওয়ার পর নতুন ভোটার তালিকায় তাঁর নাম খয়রু শেখ লেখা হয়। নামের অমিলের জন্য নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা এবং ভোটাধিকার হারাতে পারেন বলে ভয় পান ওই বৃদ্ধ।
নাম সংশোধনের জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘোরা এবং তাতে খরচও প্রচুর হবে বলে অভিযোগ জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা। বয়সজনিত কারণে সেই ঝক্কি সামলাতে পারবেন না বলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন খায়রুল শেখ দাবি পরিবারের। এরপরেই বুধবার দুপুরে তিনি ঘাস মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। হাসপাতালের সূত্রে খবর, বিষটি অত্যন্ত মারাত্মক এবং কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে তাঁর শারীরিক অবস্থা উদ্বেগজনক হলেও তিনি অজ্ঞান অবস্থান আছেন।
কোচবিহারের ঘটনা নিয়ে সুর চড়িয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবারতিনি পানিহাটির প্রদীপের বাড়ি তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে তিনি বলেন, ‘শুধু প্রদীপই নন, এসআইআর করে এমন ভয়ের সঞ্চার হয়েছে নানা জায়গায়। আতঙ্কে চরম পদক্ষেপ করছেন মানুষ। দিনহাটায় এমন একটি ঘটনার খবর কানে এসেছে তাঁর। আত্মহত্যার চেষ্টা করা ওই ব্যক্তি এখন হাসপাতালে ভর্তি।’
পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘এক দিকে নির্বাচন কমিশন অন্য দিকে, কেন্দ্রের সরকার মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত তৈরি করে রাখছে। তারা ঠিক করছে দেশের নাগরিক কারা। এসআইআর ঘোষণা হওয়ার পরে উনি ঘরে ঢুকেছেন। সকালে দেখা গেল, উনি বেঁচে নেই। এটা কি কাকতালীয়। এঁদের মৃত্যুর জন্য দায়ী অমিত শাহ, জ্ঞানেশ কুমার।’কোচবিহারের পুলিশ সুপার সন্দীপ কাররা জানিয়েছেন, দিনহাটার বাসিন্দা খায়রুল শেখ বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। সন্দীপ বলেন,‘ওঁর নাম খায়রুল শেখ। কিন্তু ভোটার তালিকায় তার নাম খয়রু শেখ লেখা আছে। এই নিয়ে তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই চিন্তিত ছিলেন বলে জানতে পেরেছি।’
পুলিশ সুপার আরও জানিয়েছেন, গ্রামবাসীদের দাবি, খায়রুল এসআইআর ঘোষণার পর থেকে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আপাতত তিনি কোচবিহার জেলা হাসপাতালে ভর্তি। তিনি একটু সুস্থ হলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার সন্দীপ। একই কথা বলেন দিনহাটার এসডিপিও ধীমান মিত্রও। তাঁর কথায়, ‘সাহেবগঞ্জ থানা এলাকার বাসিন্দা খায়রুল। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, এসআইআর-এর কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তিনি। কোচবিহারের হাসপাতালে ভর্তি। আমরা তদন্ত করে দেখছি।’
ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং কোচবিহারের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘যদি ভুলই থাকে তবে সেই ভুল তো করেছে নির্বাচন কমিশন। এসআইআর-এর নামে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে রাজ্য-সহ গোটা দেশ জুড়ে। দিশেহারা হয়ে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। ভোটের আগে এই জিনিসের অর্থ হল বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আমরা সর্বোতভাবে পরিবারটির পাশে আছি।’
এদিন ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে যান কোচবিহার জেলার তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অভিজিৎ দে ভৌমিক। তিনি ওই ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সান্ত্বনা দেন এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। অভিজিৎ জানান, ‘২০০২ সালে তাঁর নাম ছিল খায়রুল শেখ, এখন সেটা ভুলভাবে খয়রু শেখ হয়েছে। এই ভয় ও মানসিক চাপেই তিনি বিষ খেয়ে ফেলেছেন। ডাক্তাররা বলছেন, বিষটি খুব মারাত্মক, দুই-তিন দিনের মধ্যে কিডনি ফেল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
কোচবিহার উত্তরের বিজেপির বিধায়ক সুকুমার রায় বলেন, ‘উনি যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন, তার দায় তৃণমূলের। তৃণমূল এসআইআর টেনে সাধারণ সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে এনআরসি-র ভয় দেখাচ্ছে। আমরা বলেছি, যাঁরা অনুপ্রবেশকারী রয়েছেন, তাঁদের নাম থাকবে না। যে সব ভারতীয়দের ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে, তাঁদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। তৃণমূল এসআইআর-কে এনআরসি বলে প্রচার করছে। সেই কারণেই সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন।’ এই ঘটনায় দিনহাটার জিৎপুরে ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষের কথার প্রতিধ্বনি করে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এসআইআর প্রক্রিয়ায় ভুলভ্রান্তি ও তথ্য বিভ্রাটের জেরে সাধারণ মানুষ ভয় পাচ্ছেন।