• প্রকৃতির কাছেই হার মানল দিল্লি সরকার, কেন হল না ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’
    আজকাল | ৩০ অক্টোবর ২০২৫
  • আজকাল ওয়েবডেস্ক: বলিউডের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘লাগান’-এর শেষ দৃশ্যে বৃষ্টির আগমন ছিল এক প্রতীকী মোড়—যেমনভাবে গ্রামবাসীদের ক্রিকেট দলের জয়ের পর আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি, তেমনই দিল্লিবাসীও মঙ্গলবার সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির আশায় ছিল। তারা চেয়েছিল, বহু প্রচারিত মেঘ-বপন বা “ক্লাউড সিডিং” পরীক্ষার পর এক ফোঁটা বৃষ্টিই হোক রাজধানীর বিষাক্ত বাতাসের বিরুদ্ধে বিজয়ের বার্তা। কিন্তু বাস্তবতা ছিল হতাশাজনক—এক ফোঁটাও বৃষ্টি পড়েনি, আর দিল্লির ঘন ধোঁয়াশা ও দূষিত বাতাস আগের মতোই ভারী রইল।

    বিগত কয়েক বছর ধরে দিল্লির বিভিন্ন সরকার শীতকালে দূষণ কমাতে কৃত্রিম বৃষ্টির চিন্তা করে আসছে। শীতের সময় বাতাসের গতি কমে যায়, ফলে দূষিত কণাগুলি মাটির কাছাকাছি আটকে থাকে। কৃত্রিম বৃষ্টি এই কণাগুলি ধুয়ে দিতে পারে, কিন্তু এটি একেবারেই অস্থায়ী সমাধান। প্রতি বছরই রাজধানী ঢেকে যায় ঘন ধোঁয়ায়, শিরোনামে উঠে আসে “গ্যাস চেম্বার দিল্লি”। এযেন এক বার্ষিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    তবে প্রত্যেক বছরই নানা কারণে এই উদ্যোগ সফল হয়নি—কখনও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়, কখনও অনুকূল আবহাওয়ার অভাবে। মুম্বাই ২০০৯ সালেই একবার ক্লাউড সিডিংয়ের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ফলাফল হয়েছিল ব্যর্থ। ২০২৩ সালের একটি প্রস্তাবও বাস্তবায়িত হয়নি।

    ২০২৫ সালে নতুন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারও উদ্যোগ নেয় ক্লাউড সিডিংয়ের। বায়ু মান ‘অতি খারাপ’ থেকে ‘গুরুতর’ স্তরে পৌঁছানোর পর, রেখা গুপ্তা নেতৃত্বাধীন দিল্লি সরকার আইআইটি কানপুরের সঙ্গে যৌথভাবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচ দফা পরীক্ষার পরিকল্পনা নেয়। এই প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা।

    মঙ্গলবার আইআইটি কানপুরের একটি বিশেষ বিমান দিল্লির আকাশে প্রায় ৪০০ কিমি উড়ে বুরাড়ি, ময়ূর বিহার ও করোল বাগের উপর রূপালী আয়োডাইড ছড়িয়ে বৃষ্টি নামানোর চেষ্টা করে। তিন ঘণ্টা পর একই এলাকায় দ্বিতীয় দফা ছিটানো হয়।

    এখন দেখা যাক এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। রূপালী আয়োডাইডের গঠন বরফের মতো। এই ক্ষুদ্র কণাগুলি “বীজ”-এর মতো কাজ করে, যার চারপাশে জলবিন্দু জমা হয়। যখন পর্যাপ্ত বিন্দু একত্রিত হয়, তারা ভারী হয়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ায়। কিন্তু মঙ্গলবারের এই পরীক্ষায় এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। অধিকাংশ এলাকায় বায়ুমানের অবস্থাও অপরিবর্তিত রয়ে যায়।

    বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যর্থতা ছিল অনিবার্য। কারণ, ক্লাউড সিডিং নির্ভর করে আবহাওয়ার উপর—বিশেষত আর্দ্রতা ও বৃষ্টিবাহী মেঘের উপস্থিতির উপর। শীতকালে দিল্লির আকাশ সাধারণত শুষ্ক থাকে। মঙ্গলবারও যদিও আকাশ মেঘলা ছিল, তবুও মেঘে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল মাত্র ১০-১৫%, যেখানে সফল ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য প্রয়োজন ৫০-৬০% আর্দ্রতা। আইআইটি কানপুরের প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “মেঘে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকায় এটি আদর্শ পরিস্থিতি ছিল না।”

    ফলস্বরূপ, এই ব্যয়সাপেক্ষ পরীক্ষার সাফল্যের সম্ভাবনা আগেই ছিল অতি ক্ষীণ। প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে ১ লাখ টাকা খরচে এমন পরীক্ষা চালানো হয়, যা পরিবেশবিদদের মতে বাস্তবসম্মত নয়। তারা বহুবার বলেছেন, কৃত্রিম বৃষ্টি কোনো জাদুকরি সমাধান নয়; এমনকি যদি বৃষ্টি হয়ও, তার প্রভাব টিকে থাকে সর্বাধিক এক-দুদিন। এরপর দূষণ আবার আগের মাত্রায় ফিরে আসে।

    উল্লেখ্য, ভারতে ক্লাউড সিডিংয়ের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকেই, পরে ১৯৭০-এর দশকে দ্বিতীয়বার এটি চালানো হয়—তখন মূল উদ্দেশ্য ছিল খরাপ্রবণ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বাড়ানো। এখন তা দূষণ নিয়ন্ত্রণের আশায় ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রকৃতির নিয়মকে এত সহজে বাঁকানো সম্ভব নয়।
  • Link to this news (আজকাল)