• ঐতিহাসিক তেঁতুল-কথা এ বার শোনা যাবে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে
    আনন্দবাজার | ৩০ অক্টোবর ২০২৫
  • স্বাধীনতা সংগ্রামীর পোঁতা, প্রায়৮০ বছরের পুরনো তেঁতুলগাছটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বাঘা যতীনের বিদ্যাসাগরকলোনিতে। কিন্তু একের পরএক বহুতল গজিয়ে ওঠার এইৎশহরে সেই তেঁতুলগাছেরঅস্তিত্ব আজ সঙ্কটে। তার ভবিষ্যৎকী, তা নির্ভর করছে প্রোমোটারে মর্জির উপরে। বিদ্যাসাগর কলোনির এই প্রাচীন তেঁতুল-কথাই এ বার জায়গা পেয়েছে কলকাতাআন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানে ভারতীয় স্বল্প দৈর্ঘ্যেরসিনেমা বিভাগে দেখা যাবে এই তেঁতুলগাছের ইতিকথা নিয়েতৈরি আধ ঘণ্টার সিনেমা— ‘জিলিপিবালার বন্ধুরা’।

    পরাধীন ভারতে অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী পারুল মুখোপাধ্যায়ের বিদ্যাসাগর কলোনির বাড়ির উঠোনে রয়েছে এই তেঁতুল গাছটি। ১৯৩৫ সালে টিটাগড় বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় আরও দুই বিপ্লবীর সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন পারুল। জেল খেটে মুক্তি পান ১৯৩৯ সালে। স্বাধীনতার পরে তিনি থাকতে শুরু করেন বিদ্যাসাগর কলোনিতে। এলাকায় পরিচিতছিলেন ‘পারুলপিসি’ বলে। স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাও ছিলেন তিনি। নিজের হাতে বাড়ির এক প্রান্তে লাগিয়েছিলেন এই তেঁতুলগাছ, যা বর্তমানে এলাকার বাস্তুতস্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ১৯৯০ সালে ‘পারুলপিসি’ মারা গেলেও রয়ে গিয়েছে তাঁর হাতে লাগানো তেঁতুলগাছটি।

    কিন্তু তাঁর পরিবার সেই ভিটেমাটি বর্তমানে প্রোমোটারের হাতে তুলে দেওয়ায় আপাততএই তেঁতুলতলার ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশপ্রেমীরা। সেই সঙ্কটের কথা তুলে ধরতেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন পড়শি তথা চলচ্চিত্র পরিচালক দেবলীনা মজুমদার। তিনি বলছেন, ‘‘মাপজোক করে দেখা গিয়েছে,এক প্রান্তে থাকা গাছটির বেশিরভাগ অংশই জমির বাইরে রয়েছে। তবে সেটুকুর জন্যও বহুতলবানাতে এত বড় গাছটি কেটে ফেলা হবে কিনা, তা নিয়ে আমরা এখনও অন্ধকারে। কিন্তু ওই গাছটি শুধু‘একটি গাছ একটি প্রাণ’ নয়, বরং বহু প্রাণের আধারও। প্রচুর পাখি-কীটপতঙ্গ-জীবজন্তুর বাসস্থান সেটি। এলাকার বাস্তুতন্ত্র অনেকাংশে এই তেঁতুলতলার উপরে নির্ভরশীল। তাই সকলের কাছে এই তেঁতুলতলার কথাই তুলে ধরতে চেয়েছি।’’

    তেঁতুলগাছের প্রতিবেশী দেবলীনা গত ১২-১৩ বছর ধরেই ওই গাছে আসা পাখিদের ছবি তুলেছেন। কিন্তু সিনেমা তৈরির শুরু কী ভাবে? দেবলীনা জানাচ্ছেন, কয়েক বছর আগে তাঁদের বাড়িতে ভাড়া আসা ছোট্ট সিমরন ওরফে জিলিপিবালাকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর ভার পড়েছিল তাঁর উপরে। ছোট্ট জিলিপিবালাকে নিয়ে পাশের তেঁতুলগাছে আসা বিভিন্ন পাখি, বেড়াল-কাঠবিড়ালি-বেজি-প্রজাপতি-পোকামাকড় চেনাতেন তিনি। আর সে সবই রেকর্ড করে রাখতেনক্যামেরায়। কয়েক বছর আগে তোলা সেই সব ফুটেজ দিয়েই তিনিবানিয়ে ফেলেছেন ‘জিলিপিবালার বন্ধুরা’— যা আসলে তেঁতুলগাছটির অস্তিত্ব সঙ্কটের কথা বলে। খুদে জিলিপিবালা ছাড়াও সেখানে রয়েছে তেঁতুলতলায় আসা দুর্গা টুনটুনি, বসন্তবৌরী, দুধরাজ-সহ ১৫-২০ রকমের পাখি, বেড়াল-কাঠবিড়ালি-প্রজাপতিরা।

    দেবলীনার কথায়, ‘‘আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে আশপাশের গাছ, প্রাণিকুলকে ধ্বংস করছি। তাই পরিবেশ রক্ষার নামে বড় বড় কথা না বলে বরং ছোট্ট পরিসর থেকে সেই কাজ শুরু করতে পারি সকলে। প্রতিদিনের যাপনে এ ভাবেও যে প্রকৃতিকে বাঁচানো যায়, সেই বার্তাই দিতে চাইছি।’’

    সিনেমাটির প্রযোজক, সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সমতা বিশ্বাসও বলছেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাব পড়তে চলেছে আগামী প্রজন্মের উপরে। তাই তারা প্রকৃতিকে চিনবে, আমাদের অ-মানুষ প্রতিবেশীদের জন্য তাদের মনে সহমর্মিতা থাকবে— সেটাই এই ছবির লক্ষ্য। জিলিপিবালার হাত ধরে আগামী প্রজন্মের দর্শকও তেঁতুলতলাকে ভালবাসুক, পরিবেশকে ভালবাসুক।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)