প্রচারের সব নিয়ম ভেঙে পাটনায় নতুন উত্তাপ ছড়াচ্ছেন সিপিআই(এম-এল) প্রার্থী দিব্যা গৌতম...
আজকাল | ৩১ অক্টোবর ২০২৫
আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাজনীতিতে বস্তির কথা কেউ বলতে চায় না — কিংবা বস্তিবাসীদের কথাও না। কিন্তু বিহার বিধানসভা নির্বাচনে দিঘা কেন্দ্র থেকে মহাগঠবন্ধনের প্রার্থী ও সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন নেত্রী দিব্যা গৌতম সেই নীরবতাকে ভেঙেছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে সেই মানুষগুলোকেই, যাদের অস্তিত্বকেই সমাজ এতদিন উপেক্ষা করেছে।
৩৪ বছর বয়সী দিব্যা গৌতম পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, কিন্তু তাঁর আসল পরিচয় রাজনীতির ময়দানেই। ছাত্ররাজনীতি থেকেই তাঁর পথচলা শুরু। তাঁর কাছে রাজনীতি ক্ষমতা দখলের উপায় নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার হাতিয়ার। তিনি বলেন, “রাজনীতি আমাদের বদলে দেয় — তাই আমাদেরই রাজনীতিকে বদলাতে হবে।”
দিব্যা গৌতমের প্রচারে নেই কোনও চাকচিক্য, নেই বড় সভা বা ব্যয়বহুল প্রচারযন্ত্র। সংকীর্ণ গলি পেরিয়ে পায়ে হেঁটে প্রচার চালান তিনি। তাঁর সঙ্গে থাকেন ছাত্রছাত্রী ও তরুণ কর্মীরা — কেউ রিকশায়, কেউ সাইকেলে, কেউবা মোটরবাইকে। ব্যানার-ফেস্টুনের আড়ম্বরের বদলে তিনি মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন — মুদ্রাস্ফীতি, শিক্ষার সুযোগ আর কর্মসংস্থানের মতো দৈনন্দিন সমস্যার প্রসঙ্গে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তাঁর প্রচারে যোগ দিয়েছে। তাঁদের স্লোগান — “এক হি নারা, তিন তারা” — সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের তিন তারা-ওয়ালা লাল পতাকার প্রতি ইঙ্গিত। এমনকি কর্ণাটক থেকেও কিছু ছাত্র তাঁর সমর্থনে প্রচারপত্র বিলি করছেন।
“আমাদের প্রচার মানুষ চালাচ্ছে। আমাদের কোনও বড় ফান্ডার নেই, পিআর টিমও নেই — আমরা মানুষকেই ভরসা করি,” বলেন দিব্যা। তাঁর কথায়, “গরিব, মহিলা ও সাধারণ মানুষ মনে করেন রাজনীতি তাঁদের জন্য নয়। কারণ রাজনীতিকে ‘বাহুবলি’দের ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে — এটা আসলে জনগণকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার কৌশল।”
অনীসাবাদের সরু রাস্তায় প্রচারের ফাঁকে এক চায়ের দোকানে বসে দিব্যা জনতার সঙ্গে কথা বলছিলেন। পাশেই মোবাইল দোকান, স্টেশনারি স্টল আর এক ছোট মাজার — যার দেওয়ালে হিন্দু দেবতার ছবিও টাঙানো। সেখানে উপস্থিত জনতাকে তিনি বলেন, “পরিবর্তনের সময় এসেছে। ভোট দিয়ে সেই পরিবর্তনের অংশ হোন।”
প্রচারের মাঝেই তিনি মাজারে প্রণাম জানিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। কয়েকজন মহিলা, যারা সেখানে প্রার্থনা করতে এসেছিলেন, তাঁকে ঘিরে গল্প শুরু করেন। তাঁদের একজন বলেন, “ও রাজনীতিবিদদের মতো আচরণ করেন না। ও যেন আমাদের মেয়ের মতো।” দিব্যা বলেন, “আমরা এমন একটা সমাজ গড়তে চাই, যেখানে হিন্দু-মুসলমান, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী — সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বাস করতে পারবে।”
এরপর দলটি পেরিয়ে যায় রাঘোটোলা এলাকায় — একটি শহুরে গ্রাম। সেখানেও তাঁকে যোগ দেন আরজেডি-র স্থানীয় কর্মীরা। মহাগঠবন্ধনের মিত্র দলগুলোর এই মাঠের ঐক্য দৃশ্যমান।
দিব্যা গৌতমের এই নীরব অথচ প্রাণবন্ত প্রচার ইতিমধ্যেই জাতীয় স্তরে দৃষ্টি কেড়েছে। দেশের নানা প্রগতিশীল সংগঠন তাঁর সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছে। কেরালার নাগরিক সমাজ তাঁকে সমর্থন জানিয়েছে। তুষার গান্ধী, ড. সুনীলম (পদার্থবিদ সুনীল মিশ্র) প্রমুখ প্রবীণ সমাজকর্মীরা তাঁর হয়ে প্রচার করেছেন। শীঘ্রই যোগেন্দ্র যাদব তাঁর সমর্থনে একটি সভায় বক্তব্য রাখবেন বলে জানা গেছে।
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, দিব্যার লড়াই একেবারে ‘ডেভিড বনাম গোলিয়াথ’-এর মতো। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি নেতা সঞ্জীব চৌরাসিয়া দুইবারের বিধায়ক, স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বিপুল অর্থবল ও সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী। বিজেপি-জেডিইউ জোটের বিরুদ্ধেই তাঁর লড়াই।
এছাড়া জন সুরাজ পার্টি বিট্টু সিং-কে প্রার্থী করেছে — এক উচ্চবর্ণ নেতা, যিনি ত্রিভুজ লড়াই তৈরি করেছেন। যদিও ওই দলে সাংগঠনিক ভিত্তি নেই, প্রাশান্ত কিশোরের ভাবমূর্তি আর কিছু ভাড়াটে প্রচারকই তাদের ভরসা। তবুও ভোটে বিভাজন তৈরি করার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
২০০৮ সালের সীমা পুনর্নির্ধারণের পর গঠিত দিঘা আসন প্রথমে ২০১০ সালে জেডিইউ জেতে, তারপর থেকে বিজেপির দখলেই আসনটি। এই প্রেক্ষাপটে আরজেডি-র মাঠ পর্যায়ের সমর্থন দিব্যার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নির্বাচনী উত্তাপ যত বাড়ছে, দিব্যা গৌতমের জনসংযোগমূলক প্রচার ততই গতি পাচ্ছে। পাটনার বস্তি থেকে শুরু করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পর্যন্ত, তাঁর লড়াইয়ের বার্তা আলোচনায় উঠে আসছে।
যদি তিনি সঞ্জীব চৌরাসিয়াকে পরাজিত করতে পারেন, তাহলে শুধু একটি আসন নয় — তিনি জিতে নেবেন এক রাজনৈতিক ইতিহাসও। তখন তাঁকে মনে রাখা হবে ‘দিঘার জায়ান্ট কিলার’ হিসেবে — সেই তরুণ নেত্রী, যিনি বিহারের রাজনীতিতে আবার ফিরিয়ে আনলেন জনগণের প্রগতিশীল রাজনীতির আত্মা।