• মসজিদ কমিটির জায়গাতেই জগদ্ধাত্রী পুজো! মসজিদ কমিটির সম্পাদকও সামিল মাতৃ আরাধনায়...
    ২৪ ঘন্টা | ৩১ অক্টোবর ২০২৫
  • বিধান সরকার: মসজিদ কমিটির জায়গায় হয় জগদ্ধাত্রী পুজো (Jagaddhatri Puja 2025)। হিন্দু (Hindu) মুসলিম (Muslim) খ্রিস্টান (Christian) নারীরা তাঁদের লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা থেকে পুজোর জন্য টাকা জমান। উৎসবের অন্য চেহারা চন্দননগর (Chandannagar) পাদ্রী পাড়ায়। মসজিদ কমিটির সম্পাদক জগদ্ধাত্রী পুজোর সহ-সম্পাদক ইমতিয়াজ হোসেন প্রতিমার খরচ দেন। চাঁদা তোলা থেকে ভোগের দায়িত্ব সামলানো, জগদ্ধাত্রী পুজোর জোগাড় ইত্যাদি করেন জোসেফ-সহ অ্যানারা। চন্দননগরের এই জগদ্ধাত্রী পুজোকে ঘিরে এ যেন এক মহা মিলন উৎসব!

    সম্প্রীতির জগদ্ধাত্রী পুজো

    কীভাবে শুরু হল এই সম্প্রীতির জগদ্ধাত্রী পুজো? শুধু পুরুষরাই নন, ভিন্ন ধর্মের মহিলারাও একযোগে পুজোর সঙ্গে যুক্ত। জগদ্ধাত্রী পুজোয় চন্দননগরের বিশাল আকারের প্রতিমা আর আলোকসজ্জা দেখতে আসেন হাজার হাজার মানুষ। সেই ফরাসি আমল থেকেই জগদ্ধাত্রী মানে আলাদা আবেগ এখানকার মানুষের মধ্যে। পাদ্রী পাড়ার একই জায়গায় জগদ্ধাত্রী, ঈদ ও বড় দিনের উৎসব পালন হয়। সম্প্রীতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন চন্দননগরের পাদ্রীপাড়ায়। এই পুজো অবশ্য শুরু হয়েছিল ৪২ বছর আগে। সেই সময়ে আদি মা, বাগবাজার তেঁতুলতলা ও বড়বাজার জগদ্ধাত্রীর যখন জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো চলছে, সেই সময়ই এই পুজো কমিটির সদস্যরা পুজো করবেন মনস্থির করেন। 

    ধর্মে-কর্মে মিল

    যেমন চিন্তা তেমনই কাজ। পুজো শুরু হয় পাদ্রীপাড়ায়। চন্দননগর পৌর নিগমের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাস্তার ওপরেই সকল সম্প্রদায়ের মানুষ পুজোয় সম্মিলিত হন। পরবর্তীকালে প্রশাসন রাস্তায় পুজো বন্ধ করলে পুজো কমিটি মসজিদ কমিটির সঙ্গে মিলে রাস্তার পাশে জায়গা কিনে পুজো করতে শুরু করে। দুই কমিটির পৃথক দলিল হলেও স্থির হয় ওই জায়গায় কোনো স্থায়ী নির্মাণ হবে না। ঈদ পুজোয় ব্যবহার করা হবে। সেই মত  মসজিদ কমিটি জায়গাতেই মা জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বসানো হয়। আর পুজো কমিটির জায়গায় মন্ডপ তৈরি হয়। এমনকি পুজো কমিটির জায়গার দলিলে নাম রয়েছে মুসলিম সম্প্রদায় মানুষের। পুজো আচার অনুষ্ঠান সব কিছুর দায়িত্বে থাকেন পাড়ার সকলে। এই ভাবেই সকল ধর্ম মিলে গেছে এই পাড়ায়।

    পাশাপাশি ঈদ ও বড়দিন

    এই পাড়ার নামেরও একটি ইতিহাস আছে। ফরাসি আমল থেকেই এই পাড়ায় থাকেন চার্চের পাদ্রীরা। সেই থেকেই নাম হয় পাদ্রীপাড়া। পাড়ার কিছুটা দূরেই রয়েছে চন্দননগর সেক্রেড হার্ট চার্চ। সেই কারণেই এই পাড়াতেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষও বাস করেন। আর এই পাড়াতেই রয়েছে বড় মসজিদ। অর্ধেকের বেশি হিন্দু ধর্মের মানুষ থাকলেও বাকিটা মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের মানুষ একত্রে বাস করেন। তাই পরস্পরের সঙ্গে সুখদুঃখ ভাগ করে নেন তারা। জগদ্ধাত্রী পুজোর এই উৎসবে সকলে সামিল হন। ঈদ ও বড়দিনের উৎসবে এক সঙ্গে থাকেন তারা।

    মনুষ্যধর্মই বড়

    এই পুজোর থিম এবছর জল বাঁচাও। জলের যেমন কোন রঙ বা জাত হয় না, এ পাড়ার মানুষজন বিশ্বাস করে মনুষ্যধর্মকেই। সকলেই এক। এই পাড়ার দীর্ঘদিন থেকে এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত এক সক্রিয় সদস্য প্রধান উপদেষ্টা স্বপন সাহা বলেন, আমাদের এক পাশে রয়েছে মসজিদ আর একপাশে গির্জা। ৪২ বছর ধরে সকলে মিলে জগদ্ধাত্রী পুজো করি। সকলে এক সঙ্গে মিলে আমরা কাজ করি। নবমীর দিন একসঙ্গে বসে ভোগ খাই আমরা। এখানেই ঈদ ও বড়দিনের উৎসব করি। উৎসব মানে উৎসব কোন ধর্ম নয়। আমাদের জগদ্ধাত্রী পুজোয় এলে দেখতে পাবেন মায়ের প্রতিমা বসে মসজিদ কমিটির জায়গায়। মন্ডপ সজ্জা করতে গিয়ে আমাদের জায়গার সংকুলান হয় না। মা জগদ্ধাত্রী পুজো থেকে বিসর্জন পর্যন্ত একসঙ্গে আমরা উৎসব পালন করি। আমাদের পাদ্রীপাড়ায় চল্লিশ শতাংশ খ্রিস্টান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন বাস করেন, বাকিটা ৬০ শতাংশ  হিন্দু ধর্মের। সকলেই নিজের সাধ্যমতো পুজোর জন্য চাঁদা নিজেরা দেন। বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে আনেন। এই রাস্তার নাম বিবেকানন্দ সরণি কিন্তু পাদ্রীরা থাকতো বলে এইখানকার নাম পাদ্রীপাড়া। আগে বয়স্ক মানুষ এই পুজোর সঙ্গে যেমন যুক্ত ছিল। এখন নতুন প্রজন্মের সমস্ত ধর্মের পুরুষ, মহিলারাও এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত আছে।

    একত্রে আনন্দ উপভোগ

    এই পুজো কমিটির সহ-সম্পাদক ইমতিয়াজ হুসেন আবার মসজিদ কমিটির  সম্পাদক। তিনি বলেন, গত ১২ বছর ধরে এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত। সকলে মিলেমিশে আমরা এই পুজো করি। পুজোর জন্য চাঁদা তোলা থেকে প্রতিমার খরচ দেওয়া। আমি প্রতিমার জন্য ৪২ হাজার টাকা দিয়েছি। এই পুজোর সঙ্গে আমাদের আবেগ ভালবাসা জড়িয়ে রয়েছে। আর এক সদস্য অ্যানা বিশ্বাস বলেন, বিয়ের পর এই পাড়ায় এসে পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। সমস্ত মহিলা মিলে এই পুজোর দিনগুলি আনন্দ উপভোগ করে আসছি আগামী দিনেও করে যাব।

  • Link to this news (২৪ ঘন্টা)