নিমপাতা দাঁতে কাটার পরে যদি মিষ্টি লাগে, তবে ওঁরা বুঝতে পারেন, বিষধর সাপ কামড়েছে। আবার যদি কোনও এলাকায় গোসাপের দেখা পান কাজ করতে গিয়ে, তবে ওঁরা ধরে নেন, সেই জায়গায়সাপের উপদ্রব নেই। দূষিত কালো জলে কাজ করতে করতে ভয়ঙ্কর চর্মরোগে আক্রান্ত হন ওঁরা। শরীর বাঁচাতে উপশম হিসেবে গায়ে পোড়া মোবিল মেখে জলে নামেন। প্রতিদিন জীবনের এবং নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও সেচ ব্যবস্থাকে সচল রাখার কাজ করে চলেন ওঁরা। উন্নয়নের রাজ্যে কেউ খবর রাখেন না সেই সব সেচ শ্রমিকের দুর্দশার।
বাগজোলা থেকে চৌবাগা, নোয়াই থেকে উত্তর ভাগ— প্রতিটি খালেই বিপদ লুকিয়ে রয়েছে নানা রূপে। বিষাক্ত গ্যাস থেকেবিষাক্ত সাপ, কাঁকড়াবিছে বা বিষাক্ত পোকা— সব রকম বিপদ মাথায় নিয়েই খাল এবং নদীতে পানা তুলতে নেমে পড়েন পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকেরা। কখনও ছোট ডিঙি নিয়ে, কখনও আবার সরাসরি বুক পর্যন্ত গভীর জলে নেমে খাল-নদী থেকে পানা তুলে জলের গতিবাধামুক্ত করেন তাঁরা। অথচ, তাঁদের সুরক্ষার জন্য না আছে বিমা, না আছে নিরাপদে কাজ করার যথাযথ পরিকাঠামো। সেই কাজ করতে গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তাঁরা। কখনও ফেরেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকেও।
দিন পনেরো আগের কথা। উত্তর ২৪ পরগনার শাসনের কাছে বিদ্যাধরীর শাখা নদীতে পানা তুলতে নেমে সাপের কামড় খান সিরাজুল হক নামে এক শ্রমিক। আবার গত বছর বারুইপুরের উত্তর ভাগ খালে একই ভাবে পানা তুলতেনেমে সাপের কামড় খান এক মহিলা। দু’জনেই কোনও মতে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন। সেচ শ্রমিকেরা জানান, চন্দ্রবোড়া, গোখরো কিংবা কালাচের মতো বিষাক্ত সাপ অনেক খালেই থাকে। কারণ, পানায় থাকা ব্যাঙ, পোকামাকড় খেতেই সাপ চলে আসে সেখানে। উত্তর ২৪ পরগনা,দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ির মতো জায়গায় খালে ও নদীতে সাপের ভাল রকম উপদ্রব আছে বলেই জানাচ্ছেন সেচ শ্রমিকেরা। জলে নেমে পানা সরানোর বিকল্প সরকারি পরিকাঠামো কার্যত নেই বলেই দাবি সেচ শ্রমিকদের সিংহ ভাগের।
সইফুল লস্কর নামে এক শ্রমিক সর্দার জানান, কলকাতা শহরের কাছে চৌবাগা, বাগজোলা কিংবা নোয়াইয়ের মতো খালে প্রচুর সাপ রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকেরা সাপের কামড়ের ভয়ে কাজে নামবেন না, তাতো সম্ভব নয়। ফলে, পানায় নামার আগে কখনও স্প্রে করা হয়। শ্রমিকেরা সতর্ক থাকেন।
সইফুলের কথায়, ‘‘শরীরে কাটা কিংবা ফোটার যন্ত্রণা উপলব্ধি হলে প্রথমেই জখম শ্রমিককে নিমপাতা চিবিয়ে খাওয়ানো হয়। যদি তখন মিষ্টি স্বাদ লাগে, তবে বুঝতে হবে, বিষধর সাপ কামড়েছে। তখন তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’’ নিমপাতার এই টোটকা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে বলেই জানান শ্রমিকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদারের কথায়, ‘‘জলে নামার আগে অনেক সময়ে কাঁটাযুক্ত লাঠি দিয়ে পানার জঙ্গলে বারি মারা হয়। তাতে সাপ পালায়। নয়তো কাজ শুরুর আগে পানার জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আর যে সব এলাকায় গোসাপ আছে, সেখানে সাপের উপদ্রব নেই।’’ ওই ঠিকাদারের দাবি, দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকদের চিকিৎসা-সহ অন্যান্য সাহায্য করেন তাঁরা।
এ সব ঘটনার খবর কখনও সখনও পৌঁছয় সল্টলেকে, সেচের সদর দফতর জলসম্পদ ভবনে। তবে তাতে শ্রমিকদের বিশেষ সুরাহা হয় না বলেই দাবি। বহু প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার খবর প্রকাশ্যে আসার পরে শহরাঞ্চলের উঁচু বাড়িতে কাজের সময়ে সম্প্রতি শ্রমিকদের নিরাপত্তার কিছুটা ব্যবস্থা করেন ঠিকাদারেরা। কিন্তু খালে-নদীতে নেমে সাপ-বিছের কামড় কিংবা ইনজেকশনের সুচ, ভাঙা অ্যাম্পিউলে জখম শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানোর যথাযথ পরিকাঠামো সরকারি ভাবে কার্যত নেই বলেই অভিযোগ।
সেচ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এই শ্রমিকেরা ঠিকাদারের অধীন। ফলে তাঁদের দেখাশোনার দায়িত্বও ঠিকাদারের। কিন্তু যদি শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকটি না দেখা হয়ে থাকে, সেটা অনুচিত। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’’