রাজ্যজুড়ে খোলা হচ্ছে২৯৪টি ওয়ার রুম ও প্রায় ৬ হাজার সহায়তা কেন্দ্র
দৈনিক স্টেটসম্যান | ০১ নভেম্বর ২০২৫
এসআইআর ইস্যুকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে কিনা তা নিয়ে আশা-আশঙ্কার দোলাচল বাড়ছে আমজনতার মধ্যে। এসআইআর ভীতি ক্রমশ আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মধ্যে। রাজ্যে এসআইআর চালু হওয়ার পরেই আত্মঘাতী হয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির বাসিন্দা প্রদীপ কর। এমনই এক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে কোমর বেঁধে মাঠে নামছে তৃণমূল। শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি নয়, কী করলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব তা নিয়ে শুক্রবার মেগা বৈঠক করেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এসআইআর ইস্যুতে সুর চড়িয়েছেন। তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, একটা নামও বাদ পড়লে তৃণমূল ছেড়ে কথা বলবে না। এমনই এক আবহে শুক্রবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠক নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দলীয় নেতা-কর্মীদের ভোকাল টনিক দেওয়ার পাশাপাশি সমস্যার সমাধানে একগুচ্ছ নির্দেশ জারি করেছেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত—আগামী ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যজুড়ে মোট ৬ হাজার ২০৮টি সহায়তা কেন্দ্র খোলা হবে। সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই কেন্দ্রগুলি কাজ করবে। গ্রাম, পঞ্চায়েত এলাকা ও পুরসভার প্রতিটি অংশে এই সহায়তা কেন্দ্র থাকবে। সেখানে থাকবে ল্যাপটপ, প্রিন্টার ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ রাখা হবে, যাতে বিশেষ নিবিড় সংশোধন সংক্রান্ত কোনও নাগরিকের সমস্যা সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করা যায়। অভিযোগ জানানোর জন্য ‘দিদির দূত’ অ্যাপও খোলা থাকবে। প্রতিদিনের কাজের খুঁটিনাটি প্রতিবেদন পাঠানো হবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দপ্তর ক্যামাক স্ট্রিটে। আগামী ছয় মাস দলের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মীদের এইসব সহায়তা কেন্দ্র এবং প্রতিটি অঞ্চলে দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। কোনোরকম ঢিলেমি বরদাস্ত করা হবে না।
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যের মোট প্রায় নব্বই হাজার বুথের জন্য বুথস্তরের প্রতিনিধিদেরও নতুন করে সাজানো হচ্ছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় নেতা-কর্মীদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন— বুথস্তরের আধিকারিকরা যখন বাড়ি বাড়ি যাবেন, তখন বুথস্তরের প্রতিনিধিরা কার্যত তাঁদের ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়ে পাশে পাশে থাকবেন। এক মিনিটের জন্যও যেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের নজরদারির বাইরে রাখা না হয়— এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের অভিযোগ, প্রকৃত ভোটারদের নাম বাদ দিতে বিজেপি চেষ্টা করতে পারে। তাই আরও সতর্কতা প্রয়োজন।
শুক্রবারের ভার্চুয়াল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের সাংসদ, বিধায়ক, ব্লক সভাপতি, পঞ্চায়েত প্রধান মিলিয়ে মোট প্রায় ১৮ হাজার নেতা–কর্মী। বিশেষ নিবিড় সংশোধনের প্রতিটি ধাপ নিয়ে তাঁদের বিস্তারিত জানিয়ে দেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
দলের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি এলাকার অস্থায়ী শিবিরে বুথস্তরের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব থাকবে, নাগরিকরা যে এনুমারেশন ফর্ম পাবেন, তা পূরণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া। এজন্য প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও পৌর ওয়ার্ডে সক্রিয় নজরদারি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, রাজ্যে ৩৩৪৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ২৯০০ মিউনিসিপালিটি ওয়ার্ড থাকায় কাজের পরিমাণও বিপুল। তাই জেলা থেকে ব্লক ও অঞ্চলস্তরের নেতাদের নিয়ে বিস্তৃত নিয়ন্ত্রণ–ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়া রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা এলাকায় ১টি করে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বা ওয়ার রুম স্থাপনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে, যেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিধায়ক বা ব্লক সভাপতি সার্বিক বিষয় দেখভাল করবেন। সেখানেও রাখা হবে কম্পিউটার জানা কর্মী, যাতে দ্রুত মানুষের সমস্যার সমাধান করা যায়।
জানা গিয়েছে, প্রত্যেক বিধানসভায় এই ওয়ার রুমের গঠন কেমন হবে, তা-ও বলে দেওয়া হয়েছে। ব্লক সভাপতি, বিধায়ক এবং সাংসদরা সেই ওয়ার রুম বা যুদ্ধঘরের তদারকি করবেন। প্রতিটি ওয়ার রুমে ১৫ জন করে দায়িত্বে থাকবেন। ১০ জন বিএলএ-২’দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। এঁদের মধ্যে পাঁচ জন ‘ডাটা এন্ট্রি’র কাজ করবেন।
উল্লেখ্য, তৃণমূলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই জেলাভিত্তিক এক জন করে বিএলএ-১ নিয়োগ করার কাজ সেরে ফেলা হয়েছে। যিনি জেলা স্তরের নির্বাচনী আধিকারিক এবং দলের নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয় রাখবেন। এর পর শুক্রবারের বৈঠক থেকে আরও দু’টি পদ তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্লক ও পঞ্চায়েত স্তরে এই দুটি পদের পোশাকি নাম ‘ব্লক ইলেক্টোরাল রোল সুপারভাইজ়ার’ বা বিইআরও এবং ‘পঞ্চায়েত ইলেক্টোরাল রোল সুপারভাইজ়ার’ বা পিইআরএস। তবে পুরসভা স্তরে এই কাজের গুরুত্ব আরও বাড়ানো হয়েছে। এখানে ওয়ার্ড ভিত্তিক এক জনকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এলাকা ভিত্তিক ইস্যুগুলির উপরও জোর দিয়েছেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’। অর্থাৎ কোন অঞ্চলে কোন বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব বাড়াতে হবে সেবিষয়ে একটি স্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন অভিষেক। এজন্য জেলা ভিত্তিক পৃথক পৃথক নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম যাতে ভোটার তালিকা থেকে বাদ না যায়, সে ব্যাপারে মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো জেলা নেতৃত্বকে এখন থেকেই সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তাঁর নির্দেশ, সশরীরে উপস্থিত থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করাতে হবে। যে পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যের বাইরে রয়েছেন, তাঁদের রাজ্যে ফিরিয়ে এনে ফর্ম পূরণ করানোর নির্দেশও দিয়েছেন অভিষেক। এজন্য দলের তরফে সবরকম সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে।
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে, বিশেষ করে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের নেতৃত্বকে অভিষেক নির্দেশ দিয়েছেন, শুধু চা বাগানে বসে না থেকে শ্রমিক বস্তির ঘরে ঘরে যেতে হবে। তিনি মতুয়া এলাকায় শিবিরের গুরুত্ব বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বীরভূম ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলাকেও পৃথকভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। বীরভূমের নেতা অনুব্রত মণ্ডলকে একাধিক পরামর্শ দিয়েছেন অভিষেক। সেখানে দলের সকলের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার কথা বলেছেন। এছাড়া পূর্ব মেদিনীপুরের জন্য পৃথক আইনি সেল খোলারও ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে।
এদিকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও আগামী কয়েক মাস রাস্তায় থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে যাতে বিজেপি কোনও প্রকৃত ভোটারের নাম বাদ দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেই এই উদ্যোগ।’ তিনি আরও জানান, বৈধ কোনও ভোটারের নাম বাদ গেলে বিষয়টি নিয়ে রাজধানী দিল্লিতে গিয়ে আন্দোলন করা হবে।
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে সম্প্রতি প্রকাশিত তালিকার একাধিক অমিল ধরা পড়েছে। তৃণমূলের অভিযোগ, বিশেষ নিবিড় সংশোধনের নামে কিছু জায়গায় বাছাই করে নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। সেজন্য কোনওরকম ঢিলেমি রাখতে চাইছে না তৃণমূল। সব মিলিয়ে, ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনকে কেন্দ্র করে রাজ্যজুড়ে শক্তিশালী প্রহরার ব্যবস্থাই গড়ে তুলছে শাসক শিবির—যাতে একজন প্রকৃত ভোটারের নামও বাদ না পড়ে।
৩ নভেম্বরের মধ্যে বিএলএ ২–দের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে তালিকা কমিশনকে দিতে হবে
বিএলও’রা বাড়ি বাড়ি গেলে তাঁদের সঙ্গে থাকুন
বিএলএ ২–রা সব তথ্য দেখে নিয়ে দিদির দূত অ্যাপে তুলুন
প্রতিটি বিধানসভায় ওয়ার রুম হবে
তিন হাজার ৩৩৪৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ২৮০০’র মতো পুর ওয়ার্ডে ৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত হেল্প ডেস্ক
হেল্প ডেস্কে থাকবে ল্যাপটপ, প্রিন্টার এবং নেট কানেকশন
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হেল্প ডেস্ক চালু থাকবে
বাংলা জুড়ে ৬২০৮টি সহায়তা ক্যাম্প হবে
‘দিদির দূত’ অ্যাপে ৮১৪২৬৮১৪২৬ নম্বরে ফোন করে জানান
২০০২-এর ভোটার তালিকায় বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে
২০০২-এর হার্ড কপি সঙ্গে রাখুন, প্রয়োজনে অনলাইন কপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন