• সল্টলেকের পথ না সুন্দরবনের মানচিত্র! পিচ উঠে অলিগলিতে নুড়ির কঙ্কাল, খানাখন্দ-ভরা রাস্তায় হোঁচট খাচ্ছেন রোগীও
    আনন্দবাজার | ০১ নভেম্বর ২০২৫
  • তিন রাস্তা, চার রাস্তা, সব রাস্তা সমান!

    সল্টলেকে হাঁটতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষের লাইন মনে পড়ে গেল। সেক্টর ৩ হোক বা সেক্টর ৫— সড়ক থেকে গলির বাঁক ঘুরতেই সব সমান! পিচঢালা পাকা রাস্তা গ্রামগঞ্জের কাঁচা রাস্তার চেয়েও বেহাল! যত্রতত্র পিচ উঠে গিয়ে তৈরি হয়েছে খানাখন্দ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পিচ দিয়েই কেউ রাস্তার উপর টুকরো টুকরো দ্বীপ সংবলিত সুন্দরবনের মানচিত্র এঁকেছেন। দিনের পর দিন সেই তার উপর দিয়েই গাড়ি চলছে। মানুষ হোঁচট খাচ্ছেন। লাফিয়ে উঠছে অ্যাম্বুল্যান্স!

    কলকাতার উপকণ্ঠে পরিকল্পিত, শৌখিন উপনগরী সল্টলেক। আইপিএস অফিসার থেকে শুরু করে মন্ত্রী, সরকারি আমলা, প্রাক্তন ও বর্তমান বিচারপতি, রাজনীতিকদের বাস এখানে। সাজানো-গোছানো উপনগরীর রাস্তাঘাটের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিল আনন্দবাজার ডট কম। গাড়ি চলাচলের মূল রাস্তাগুলি মসৃণ, ঝকঝকে। ধাক্কা গলিতে ঢুকে। পিচ উঠে নুড়িপাথরের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে বহু রাস্তায়। তার উপর বৃষ্টির জল জমে থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল। খানাখন্দ এড়াতে গিয়ে তৈরি হয়ে যাচ্ছে যানজট!

    সেক্টর ফাইভে কলেজ মোড় থেকে আরএস সফ্‌টঅয়্যার মোড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তায় ছোট ছোট গর্ত। কয়েকশো মিটারের মধ্যে অন্তত ১৫টি জায়গায় পিচের ‘ছাল’ উঠে গিয়েছে। কোথাও কোথাও অবশ্য ঘায়ে ‘মলম’ লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তা নিতান্তই দায়সারা। ফলে লাভ হয়নি। সেক্টর ৩-এর ফোর্থ অ্যাভিনিউয়ের আশপাশের এলাকা বেশ কিছু অফিসের ঠিকানা। এক আইপিএস অফিসারের বাংলোর সামনে গিয়ে দেখা গেল, রাস্তায় পিচ নেই! বরং তার জায়গায় চেয়ে রয়েছে ভেজা এবড়োখেবড়ো পাথর। জিডি ব্লকের বাসিন্দা এস লাহিড়ি বরিষ্ঠ নাগরিক। রাস্তার কথা বলার সুযোগ পেয়ে ক্ষোভ উগরে দিলেন, ‘‘অসুবিধা তো আমাদের হচ্ছে। এক দিকে গাড়ি পার্ক করা। অন্য দিকের রাস্তা ভাঙা। আমরা হাঁটব কোথা দিয়ে?’’ ১২ নম্বর ট্যাঙ্ক থেকে ১০ নম্বর ট্যাঙ্কের দিকে যেতে এফই ব্লকের এক টোটোচালক বললেন, ‘‘এই রাস্তার জন্য প্রতি দিন টোটোর কিছু না কিছু ক্ষতি হচ্ছে। আমরা যে কী সমস্যায় আছি, শুধু আমরাই জানি।’’

    সেক্টর ৩-এর জিডি ব্লক সংলগ্ন এলাকায় পর পর তিনটি হাসপাতাল। সঙ্গে রয়েছে স্কুল, ছোটদের পার্ক, টেনিস অ্যাকাডেমি। এই এলাকায় গাড়ি বা বাইকের নিত্যসঙ্গী ঝাঁকুনি। বৃষ্টিতে রাস্তা পিছল হয়ে বাইক উল্টে যাওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে। সন্তানদের পার্কে নিয়ে এসেছিলেন সীমা মণ্ডল, রত্না দাসেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘রাস্তার অবস্থা তো খুব খারাপ। এখানে তেমন পুলিশও থাকে না।’’ মণিপাল হাসপাতালের সামনের রাস্তার অবস্থাও শোচনীয়। মূল সড়ক থেকে সার্ভিস রোডে ঢুকতেই দিকে দিকে খানাখন্দ। বৃষ্টির জলে গর্ত ভরে উঠেছে। তার মধ্য দিয়েই অ্যাম্বুল্যান্স আসছে-যাচ্ছে। রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিরাপদে ঢোকানোই যেন চ্যালেঞ্জ! এক বৃদ্ধকে স্ট্রেচারে তুলছিলেন আমন অরোরা। এই রাস্তায় রোগী নিয়ে নিরাপদ বোধ করছেন? প্রশ্ন শুনেই বলে উঠলেন, ‘‘একেবারেই না! কী অবস্থায় রোগী নিয়ে যেতে হচ্ছে, দেখতেই তো পাচ্ছেন! কী করব?’’ হাসপাতালের কর্মীরাও নিরুপায়। এবড়োখেবড়ো খানাখন্দের উপর দিয়ে হুইল চেয়ারে রোগীকে নিয়ে যেতে যেতে এক জন বললেন, ‘‘রাস্তা খারাপ। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। সাবধান থাকা ছাড়া উপায় নেই।’’

    বিধাননগর পুরনিগমে রাস্তার দায়িত্বে অনিতা মণ্ডল। তিনি আবার ডেপুটি মেয়রও বটে। বেশ কিছু জায়গায় রাস্তা খারাপ, মেনেই নিলেন অনিতা। ‘খলনায়ক’ হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন বৃষ্টিকে। ডেপুটি মেয়রের কথায়, ‘‘পুজোর আগে প্রতি বছর প্যাচওয়ার্ক (রাস্তায় পিচের প্রলেপ দেওয়ার কাজ) হয়। এ বার এত বৃষ্টির কারণে সেই কাজ শুরু করা যায়নি। বার বার কাজে বাধা এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আর আমাদের হাতে নেই। সে ভাবে কাজ করা যায়নি। এখন আবার দুর্যোগ হচ্ছে। অনেক রাস্তা ভরাট করা হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে খারাপ হয়ে গিয়েছে।’’

    মণিপাল হাসপাতাল থেকে বাইপাসের দিকে যেতে বাঁ’দিকে নিউ কেবি ব্লক। রাস্তা নিয়ে সেখানকার বাসিন্দারা তিতিবিরক্ত। দাবি, এক বার করে রাস্তা তৈরি করা হয়। আবার কিছু দিনের মধ্যেই তা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। অভিযোগ, নির্দিষ্ট সংস্থাকে রাস্তা তৈরির বরাত পাইয়ে দেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবেই টেকসই রাস্তা তৈরি করা হয় না। স্থানীয় বাসিন্দা মন্টু খাঁড়ার কথায়, ‘‘পিচ উঠে রাস্তার পাথর বেরিয়ে গিয়েছে। প্রচুর ধুলো ওড়ে। বৃষ্টি না হলে তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল। বাইক নিয়ে যেতে গিয়ে অনেকে পড়েও যান।’’ এলাকার আর এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘রাস্তায় পিচ ঢালা হয়। আবার পিচ উঠে যায়। ১০০ দিনের কাজের মতো। আমাদের জন্য কোনও কাজ হচ্ছে না। এমন ভাবে পিচ ঢালছে, যাতে আবার কিছু দিন পরে রাস্তা তৈরি করতে হয়।’’

    বৃষ্টি না হয় এ বছর বেশি হয়েছে। তবে দু’-তিন বছর ধরে কেন বেহাল রাস্তা? কেন বাসিন্দাদের এই ক্ষোভ? অনিতার সাফাই, ‘‘কাউন্সিলরেরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের রাস্তার কথা জানান। প্রতি ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধি আছেন। তাঁরা যে ভাবে রাস্তার তালিকা তৈরি করে দেন, সে ভাবেই কাজ হয়।’’ রাস্তা সারাইয়ের বিশদ প্রজেক্ট রিপোর্ট (ডিপিআর) প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) পুরবোর্ডের বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন অনিতা।

    বাইপাসে ওঠার মুখে অরণ্য ভবনের সামনে আবার অন্য দৃশ্য। রাস্তা এমনিতে ভাল। কিন্তু এক জায়গায় এমন গর্ত হয়ে রয়েছে যে, বাইকআরোহী এবং গাড়িচালকেরা তা এড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাতে রাস্তার মুখে জটলা হয়ে পড়ছে। না এড়ানো যাচ্ছে গর্ত, না যানজট। রাস্তার পিচ উঠে গিয়েছে ডব্লিউবিএসিডিসি হাউসিংয়ের দিকের রাস্তায়। সেক্টর ৩-এর করুণাময়ী থেকে উইপ্রো ব্রিজের দিকে যেতে বাঁ হাতে পড়ে ডিএল ব্লক। সেখানে ঢোকার মুখেও রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। ইই ব্লকের এক বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘আসল রাস্তাটা সারিয়েছে। গলিটা সারায়নি। কী অবস্থা, হেঁটে দেখলেই বুঝতে পারবেন।’’ তাঁর এক পড়শি পাশ থেকে বললেন, ‘‘দুটো দিকই সারানোর কথা ছিল। একটা রাস্তায় কাজ হয়েছে। আমাদের দিকের রাস্তায় কোনও কাজ হয়নি। যেমন ছিল, তেমনই পড়ে রয়েছে।’’

    অনিতার অবশ্য দাবি, নতুন করে শীঘ্রই রাস্তার কাজ শুরু হবে। বৃষ্টির প্রভাব ব্যাখ্যা করলেন তিনি, ‘‘বিটুমিনের প্রধান শত্রু তো জল। এত বৃষ্টি হয়েছে যে, রাস্তা খারাপ হয়ে গিয়েছে। দুর্যোগ কাটলে আবার কাজ শুরু হবে। আমরা একাধিক রাস্তা চিহ্নিত করেছি। নজরও রেখেছি।’’ রাস্তা সারাইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য অর্থের সমস্যাও রয়েছে। আটকে আছে ‘ফান্ড’। তবে অনিতা মানছেন যে, সে কারণে জনপরিষেবার কাজ থেমে থাকতে পারে না। তাঁর কথায়, ‘‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি। টাকার একটা সমস্যা তো আছেই। আশা করি, সেটার সমাধান হয়ে যাবে। আগামী দিনে মানুষের ক্ষোভ আর থাকবে না।’’

    বিধাননগর পুরনিগমের ক্ষমতায় আছে তৃণমূল। বিধাননগরের বিধায়ক রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসু। তথ্য বলছে, গত লোকসভা ভোটের নিরিখে বিধাননগর আসনে ১১,০০০ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন সুজিত। বিধানসভা ভোট আসন্ন। এলাার বাসিন্দাদের ক্ষোভ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে নিজের কেন্দ্রের আনাচকানাচের রাস্তা মসৃণ না-করলে বিধানসভায় ফেরার রাস্তা দুর্গম হতে পারে সুজিতের।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)