চর্মরোগ আর সংক্রমণ নিত্যসঙ্গী, তবুও দূষিত জলে ডুবতেই হয়
আনন্দবাজার | ০১ নভেম্বর ২০২৫
পেট বড় বালাই। তাই খালের জলে নেমে পানা আর পাঁক সরাতে গিয়ে কখনও বিষাক্ত গ্যাস নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে যায়, কখনও শরীর ক্ষতবিক্ষত হয় ভাঙা কাচে। কখনও বা পায়ে ফুটে যায় ইনজেকশনের সুচ কিংবা ভাঙা অ্যাম্পিউল। আর প্রতিদিন আট থেকে ন’ঘণ্টা করে দূষিত জলে নেমে কাজ করার জেরে অবধারিত ভাবে শরীরে বাসা বাঁধে চর্মরোগ, স্ত্রীরোগ। সংক্রমণ হলে চিকিৎসার প্রয়োজনে জলে নামা বন্ধ করলে কাজ থেকে বসে যেতে হবে। তাই রোজগার হারানোর ভয়ে শারীরিক কষ্ট নিয়ে আর ভাবা হয় না সেচ শ্রমিকদের। অথচ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, ম্যানহোলে শ্রমিকদের নামানো যাবে না। কিন্তু নিকাশির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম খাল সংস্কারে মানবসম্পদই প্রধান ভরসা।
রাজ্যের বিভিন্ন খালের জলে নেমে পাঁক আর পানা সরানোর কাজ করে থাকেন পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকেরা। কখনও সখনও জোটে শিশু শ্রমিকেরাও। দূষিত জলে জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাস নাকে-মুখে ঢুকে অসুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা কাচে শরীর জখম হলে বহু সময়ে ঠিকাদারেরাও সাহায্য করেন না বলেই অভিযোগ। দক্ষিণ শহরতলির এমনই একটি খালে দেখা মিলল নীলিমা দাস, হামিদা নস্কর, বাবাই সর্দারের। স্থানীয় জীবনতলা এলাকার বাসিন্দা হলেও তাঁরা সবাই বিভিন্ন জেলায় গিয়ে খাল পরিষ্কার করেন। কমবেশি চর্মরোগে ভুগছেন সকলেই।
নীলিমার কথায়, ‘‘খালের জলে পশুর দেহও ফেলা হয়। বিশেষত, কলকাতার কাছাকাছি খালগুলিতে। ফলে, জলে বিষাক্ত গ্যাস থাকে। মুখে ঢাকা দিয়ে কাজ করা সম্ভব হয় না। অনেক সময়েই সেই গ্যাস শরীরে ঢুকে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। এক বার হাওড়ার একটি খালে কাজ করার সময়ে ভাঙা কাচে পায়ের পাতা ফালা ফালা হয়ে গিয়েছিল। সেপটিক হয়ে তিন মাস বাড়িতে ছিলাম। অভাবের সংসার। তাই এখন আর নিজের কথা ভাবতে পারি না।’’
সেচ শ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, খালগুলির মধ্যে বেলেঘাটা, চৌবাগা, বালিগঞ্জ, ভাঙড়, নোয়াই খুবই দূষিত। তাঁদের বক্তব্য, শহরের বাইরের খালগুলিতে জল-দূষণ কম। কিন্তু কলকাতার বহু খালের আশপাশে কারখানা থাকায় সেখানকার দূষিত জল খালে পড়ে। সেই সব খালে কাজে নামার আগে তাঁরা ওষুধ খেয়ে নেন। তবে, কী সেই ওষুধ, তা জানেন না তাঁরা। এমনকি, সেই ওষুধ যে সব সময়ে ঠিকাদারেরা কিনে দেন, তা-ও নয়। নিজেদের খরচেই সাপ তাড়ানোর স্প্রে, চুলকানির ওষুধ কিনতে হয়, কিংবা সংক্রমণের চিকিৎসা করতে হয়, এমনই অভিযোগ শ্রমিকদের।
শহরের একটি খাল থেকে পানা তোলার কাজের মধ্যেই বিষাক্ত পোকা নিয়ে ডাঙায় উঠে এলেন সেচ শ্রমিক বাবাই সর্দার। তাঁর কথায়, ‘‘এ সব এখন সয়ে গিয়েছে। সারা ক্ষণ গা-হাত-পা চুলকোয়। জল খুব নোংরা হলে শরীরে পোড়া মোবিল মেখে নিই। তাতে চামড়ায় জল কম ধরে।’’ শ্রমিকেরা জানান, শুধু এ সবই নয়, বিপদ লুকিয়ে রয়েছে খালের জলের স্রোতেও। কয়েক বছর আগে জয়নগরে ঢোঁসা খালে নেমে জলের তোড়ে ভেসে গিয়ে এক শ্রমিক লকগেটের তলায় ঢুকে যান। পরে তিনি ওই কাজই ছেড়ে দেন।
এসএসকেএম হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সুভাষ বিশ্বাস বলেন, ‘‘চর্মরোগ তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে নোংরা জলে কাজ করার সময়ে যৌনাঙ্গ দিয়ে ভয়ঙ্কর রকমের জীবাণু মহিলাদের শরীরে প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। বিশেষত, প্রসবের পরে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সেপ্টিসেমিয়া বা পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’’
সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, ‘‘এই সমস্যা আমাদের নজরে এসেছে। যাঁরা নিকাশি ব্যবস্থাকে সচল রাখতে পরিশ্রম করছেন, তাঁদের কতটা নিরাপদে রাখা যায়, তা নিয়ে ঠিকাদারদের এজেন্সিগুলির সঙ্গে দ্রুত আলোচনা হবে। সেখানে সেচের আধিকারিকেরাও থাকবেন।’’