পাতা ঝরার হেমন্তে ফিল্মোৎসব এসে গেল ফের। ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বাদ্যি বেজে গেছে: ৬ নভেম্বর উদ্বোধন গুণিজনসমাগমে, অজয় করের সপ্তপদী ছবির আবেগমূর্ছনায়, সেটিই উদ্বোধনী ছবি কিনা! ৭-১৩ নভেম্বর চেনা ভিড় জমবে নন্দন-রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে, মোট ২১টি প্রেক্ষাগৃহে।
৩৯টা দেশের, মোট ২১৫টা ছবি থাকছে উৎসবে: ১৮টি ভারতীয় ও ৩০টি বিদেশি ভাষার! আঠারোশোরও বেশি ছবি জমা পড়েছে বলে জানা যাচ্ছে, তার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক বিভাগগুলিতে লড়বে ৪৩টি কাহিনিচিত্র, ১০টি প্রামাণ্যচিত্র, ১৯টি ছোট ছবি। পোল্যান্ডের ছবি এ বার ‘ফোকাস’, ১৯টি পোলিশ ছবি দেখানো হবে। আসছেন মাইকেল কিসিনস্কি; আন্দ্রে ভাইদা-র বহু ছবির এই প্রযোজক এ বার পরিচালকের ভূমিকায়, বানিয়েছেন শপ্যাঁ: আ সোনাটা ইন প্যারিস। ছবিটি দেখানোর আগে নন্দনের মঞ্চে লাইভ পিয়ানোয় বেজে উঠবে কিংবদন্তি পোলিশ সঙ্গীতস্রষ্টার সুর!
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বিভাগ ‘ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজেস’ নিয়ে বরাবরই ছবিপ্রেমীদের আগ্রহ থাকে তুঙ্গে। এ বার ক্রোয়েশিয়া তুরস্ক গুয়াতেমালা ইটালি সেনেগাল ইত্যাদি দেশের সাম্প্রতিক ছবির সঙ্গে এই বিভাগেই রয়েছে এ শহরের চলচ্চিত্রকার প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের নতুন ছবি নধরের ভেলা, আনন্দসংবাদ। তারিফ করতে হয় এ বছরের নতুন এই বিভাগ ভাবনার— ‘বিয়ন্ড বর্ডারস: ডিসপ্লেসমেন্ট, মাইগ্রেশন’। লেবানন সুদান সোমালিয়া প্যালেস্টাইন-সহ দেশে দেশে শেকড়-ছেঁড়া, উৎখাত বা উদ্বাস্তু মানুষের সঙ্কট ও সংগ্রাম ছবিতে তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্রকাররা, সেই জীবনসত্য।
‘রেস্টোরড ক্লাসিকস’-এ সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি, শ্রীলঙ্কার ছবি গেহনু লামাই-এর পাশাপাশি খাঁটি সিনেপ্রেমী ছুটবেন প্রেম কপূরের বহুচর্চিত বদনাম বস্তি দেখতে, হলফ করে বলা চলে। ১৯২৫-এর নির্বাক ছবি, ফ্রাঞ্জ অস্টেন-হিমাংশু রাইয়ের প্রেম সন্ন্যাস/দ্য লাইট অব এশিয়া দেখানো হবে শতবর্ষে। শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হবে সলিল চৌধুরী সন্তোষ দত্ত রাজ খোসলা রিচার্ড বার্টনকে; স্মরণ করা হবে রবার্ট রেডফোর্ড ডেভিড লিঞ্চ শ্যাম বেনেগাল শশী আনন্দ থেকে রাজা মিত্র অরুণ রায়কে, তাঁদের সৃষ্টিতে। ফিলিপিন্সের বিশ্রুত পরিচালক ব্রিলান্টে মেনডোজ়া-র ছ’টি ছবির ‘রেট্রোস্পেক্টিভ’-এর পাশাপাশি বড় প্রাপ্তি তাঁর ‘মাস্টারক্লাস’ও!
উৎসব ঋত্বিক ঘটক-ময়। শতবর্ষীর স্মরণে দেখানো হবে তাঁর ৬টি কাহিনিচিত্র, অযান্ত্রিক থেকে তিতাস...। ‘কলকাতা কথকতা’র সৌজন্যে নন্দনের ফয়্যার সেজে উঠবে ঋত্বিককে নিয়ে প্রদর্শনীতে, শিশির মঞ্চে ১২ নভেম্বর বিকেলে রয়েছে ‘ঋত্বিক ঘটক মেমোরিয়াল কনভারসেশন’, ‘শিক্ষক’ ঋত্বিককে নিয়ে অনুপ সিংহের সঙ্গে কথায় আদুর গোপালকৃষ্ণন। গগনেন্দ্র শিল্পপ্রদর্শশালায় গুরু দত্ত প্রদীপকুমার রবার্ট অল্টম্যানকে নিয়ে প্রদর্শনী, দোতলায় পোস্টারে পোলিশ সিনেম্যাটোগ্রাফির যাত্রাপথ। আর যা ছাড়া ভাবাই যায় না কলকাতার ফিল্মোৎসব, সেই ‘সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা’ তো থাকছেই— ৭ নভেম্বর সকাল ১১টায় শিশির মঞ্চে। এ বারের বক্তার নামটিও চমকপ্রদ, রমেশ সিপ্পি!
শতবর্ষী
৪ নভেম্বর ফিরে আসে প্রতি বছর। এ বছরটি বিশেষ, শতবর্ষ পূর্ণ করছেন ঋত্বিককুমার ঘটক (ছবি)। তাঁর মনন ও সৃষ্টির প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হল কি না, সেই প্রশ্ন ও প্রতর্ক মনে রেখেই সে দিন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন শহরে। ‘হারমোনিকা’ ও রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম-এর উদ্যোগে বেলা ১২টা থেকে রাত অবধি নানা অনুষ্ঠান রামমোহন লাইব্রেরি হল-এই: আলোচনা কবিতা গান, ঋত্বিককে নিয়ে তথ্যচিত্রের পাশাপাশি অযান্ত্রিক ও যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-র প্রদর্শন; থাকবেন মাধবী মুখোপাধ্যায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টজন। অন্য দিকে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া (এফএফএসআই) পূর্বাঞ্চল, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই) ও বিএফটিসিসি-র উদ্যোগে ‘ঋত্বিক ঘটক স্মারক বক্তৃতা’য় সানি জোসেফ বলবেন ‘সিনেমা অব এমপ্যাথি’ নিয়ে: মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টেয় এসআরএফটিআই-তে। দেখানো হবে সুবর্ণরেখা-র ‘রেস্টোরড’ রূপ।
যখন সময়
শক্তিমানের ভণ্ডামি, নারীনিগ্রহের ধারাবাহিকতায় খুব বদল এসেছে কি সমাজে? অসহায় নিম্নমধ্যবিত্ত নিচ্ছে সময়ের আধুনিক পাঠ, পুরুষ প্রশ্রয় দিচ্ছে প্রায়-নির্বাক বশ্যতাকে। এমন এক বন্ধ্যা সময়ে বাধ্য হয়ে ধাপ্পাবাজির আশ্রয় নেওয়া এক প্রৌঢ় ও তার কন্যার রোজগারের রহস্যময় প্রাত্যহিকতা ফুরোয় ফি-সন্ধ্যায় ভাত-ওষুধের অপেক্ষায় শুয়ে থাকা, প্রৌঢ়ের অসুস্থ স্ত্রীর সামনে। এই আখ্যানই ‘হ য ব র ল’ নাট্যদলের নতুন নাটক রাত ভৈরো-তে। লিখেছেন একাশি-উত্তীর্ণ নাট্যকার চন্দন সেন, নির্দেশনায় ন্যান্সি, মুখ্য চরিত্রে দুলাল লাহিড়ী ও চলন্তিকা। আজ সন্ধ্যায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে প্রথম অভিনয় নিবেদিত ক্ষেত্রমণিকে, ১৫২ বছর ধরে দীনবন্ধু মিত্রের নীল-দর্পণ নাট্যে যাঁর আর্তনাদ শ্রুতি-স্মৃতি বাংলা থিয়েটারের। সে দিন দীনবন্ধুর প্রয়াণদিবসও।
শ্রুতি-মহাকাব্য
উনিশ শতকের পশ্চিমি শিক্ষার আলোয় গড়ে উঠেছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের মনন। তবে তাঁর হাতিয়ার হল মাতৃভাষা বাংলা। ভারতীয় পুরাণ-মহাকাব্য উঠে এল তাঁর রচনার আখ্যানকেন্দ্রে; ফর্ম, কনটেন্ট ও স্টাইল নিয়ে শুরু হল অনুপম নিরীক্ষা। তারই শ্রেষ্ঠ ফসল মেঘনাদবধ কাব্য। সাম্প্রতিক বা দূর অতীতে এ কাব্য বারে বারে পঠিত ও অভিনীত হয়েছে, বাচিক শিল্পের শিক্ষার্থীদের কাছেও এই কাব্য অবশ্যপাঠ্য, উচ্চারণীয়। এ বার এই কাব্যের একটি শ্রুতিনাটক উপস্থাপনার উদ্যোগ করেছে ‘সঙ্কল্পিতা’ আবৃত্তি সংস্থা, বিজয়লক্ষ্মী বর্মণের ভাবনা ও পরিচালনায়। আগামী ৭ নভেম্বর শুক্রবার উত্তম মঞ্চে সন্ধ্যা ৬টায় সঙ্কল্পিতা-র ছাব্বিশ জন শিল্পীর কণ্ঠে রূপ পাবে।
গীতিময়
জনপ্রিয় অভিধাগুলি অনেক সময়ই আবেগচালিত। তবে শচীদুলাল দাশকে যে বাংলা গানের চলমান বিশ্বকোষ বলা হত, তার যাথার্থ্য তর্কাতীত। পঁচিশে বৈশাখ তাঁর জন্মদিন, জন্মস্থল শিলং— এই রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ চমকিত করে। গান তাঁর সারা জীবনের ভালবাসা, কত শতসহস্র গানের কথা, সুর সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত যে তাঁর স্মৃতি ও জ্ঞানে ধরা ছিল তা বিস্ময়কর। গানের গবেষক ও ভান্ডারি হিসাবে সম্মানিত হয়েছেন, গ্রামোফোন কোম্পানিও বিভিন্ন রেকর্ড প্রকাশ করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া বহু গান খুঁজতে শরণাপন্ন হয়েছে তাঁর। লিখেছেন গল্প কবিতা সঙ্গীত-বিষয়ক প্রবন্ধ, পত্রিকা সম্পাদনা থেকে সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন, তাঁর লেখা ও সুর করা গান গেয়েছেন বহু শিল্পী। গত ১৮ অক্টোবর প্রয়াত হলেন এই সঙ্গীতবিদ-গবেষক।
নব নির্মাণ
ছেচল্লিশ বছর পেরিয়ে সাতচল্লিশে পা রাখছে ‘গণকৃষ্টি’ নাট্যদল, আগামী ৭ নভেম্বর। প্রায় অর্ধশতকের যাত্রাপথে তারা এ বার ফিরে দেখতে চেয়েছে নিজেদেরই কুড়ি বছর আগের এক প্রযোজনা তস্কর বৃত্তান্ত-কে, নতুন নির্মাণের আলোয়। উৎস নাটকটি দারিয়ো ফো-র বিখ্যাত কমেডি দ্য ভার্চুয়াস বার্গলার, সেটি অবলম্বনেই তৈরি হয়েছে নতুন নাটক মাসতুতো vice। এক চোরের চুরি করতে আসার ঘটনায় নাটকের শুরু, তবে দুই প্রতারক-যুগলের মুখোমুখি হয়ে সে বুঝতে পারে, সে একা নয়। ক্রমে সেই চোরই হয়ে ওঠে আমাদের নৈতিকতার প্রহরী, হাট করে দেয় নাগরিক ভণ্ডামি, দাম্পত্যজীবনের অবিশ্বাস। অমিতাভ দত্তের রচনা-নির্দেশনা, মুখ্য চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। প্রথম অভিনয় আগামী শুক্রবার সন্ধে সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে।
নিজস্ব স্বাক্ষর
চিত্রচর্চাজীবনের গোড়ার দিকেই তাঁর প্রতিভা নজর কেড়েছিল বিশিষ্ট শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের। অশোক মল্লিকের ছবিতে যে মানব, মানবক ও অ-মানব অবয়বগুলি দেখা যায় অহরহ, আর তাদের চিত্রণে ধরা থাকে চিত্রশিল্পীর যে একান্ত নিজস্ব তত্ত্ব ও দর্শনের স্বাক্ষর, তা-ই কি সেই গুণগ্রাহিতার কারণ? বাঙালি এই চিত্রশিল্পী তার পর পেরিয়ে এসেছেন কয়েকটি দশক, তাঁর ছবির রূপ-রূপক-রূপকল্প ক্রমশ ধ্যানগর্ভ ও জটিল হয়েছে আরও, তবে মূলের সেই চিত্রদর্শন নিহিত আজও, এখনও। শিল্পী অশোক মল্লিকের বিংশতিতম একক চিত্রপ্রদর্শনী শুরু হচ্ছে আজ থেকে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ, উদ্বোধনে রুবি পালচৌধুরী প্রণবরঞ্জন রায় প্রমুখ গুণিজন। ৯ নভেম্বর পর্যন্ত দেখা যাবে, রোজ দুপুর ৩টে থেকে রাত ৮টা। সঙ্গের ছবিটির শিরোনাম ‘ওয়েটিং ফর মর্নিং’।
জীবনরসিক
পাতা জুড়ে অনেক মুখ। মাফলার-জড়ানো ভদ্রলোক, মুখরা কাকিমা, অবাক অথবা বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকা বেড়াল! দেখলেই চেনা যায়, দেবাশীষ দেবের আঁকা ছবি: জীবনের সহজ-সরল রসে টইটম্বুর। ৮ নভেম্বর এই লেখক-চিত্রকরের ৭০তম জন্মদিন, সেই উপলক্ষে দক্ষিণ কলকাতার রিড বেঙ্গলি বুক স্টোর তাদের বই-বিপণিতে ১-৯ নভেম্বর আয়োজন করেছে প্রদর্শনী, ‘সত্তরে দেবাশীষ দেব’। থাকবে শিল্পীর প্রচুর ‘অরিজিনাল’ কাজের খসড়া, সঙ্গে ছোট-বড় নানা স্কেচ (ছবি)। শিল্পীর নিজস্ব আঙ্গিক-স্বাক্ষর ধরে রেখেছে, এমন নানা কাজের ও শৌখিন জিনিসও থাকবে: কফি মগ, ফ্লাস্ক, ব্যাগ, টি-শার্ট, কোস্টার। প্রদর্শনীর শেষ দিন প্রকাশিত হবে বই ক্যারিকেচার এবং কিছু কথা (প্রকা: ভাষা ক্রিয়েটিভস): মৃণাল সেন থেকে মেরিলিন মনরো, সত্যজিৎ রায় থেকে গুন্টার গ্রাস, শিল্পীর রঙ্গচিত্রে। সঙ্গে টুকরো স্মৃতিলেখ, ক্যারিকেচার নিয়ে শিল্পীর নিবন্ধ— এ যাবৎ অপ্রকাশিত।
স্মৃতির রাস
কলকাতায় গোসাঁই ঠাকরুনের রাস ছিল বিখ্যাত। তিনি কে তা ঠিক জানা যায় না, তবে তাঁর রাসের জন্যই এলাকাটির নাম হয় ‘রাসপল্লি’, এখানেই নবকৃষ্ণ দেব বসতি স্থাপন করেন। সেটাই পরবর্তী কালের শোভাবাজার। সে কালে সাধারণ বাড়িতেও গৃহদেবতার নারায়ণশিলা বা বিষ্ণুবিগ্রহকে কেন্দ্র করে রাসলীলা পালন হত, বাড়ি সাজানো হত শোলার ফুল, পাখি দিয়ে, থাকত কালীঘাটের শিল্পীদের আঁকা রাসলীলার পট। বাবুদের বাড়ির রাসের ব্যবস্থা হত এলাহি। রূপলাল মল্লিকের বাড়ির রাসে খানাপিনা-নাচগানের আয়োজন হত সাহেবদের মনোরঞ্জনে। অন্য দিকে গোকুলচন্দ্র মিত্র প্রতিষ্ঠিত, বাগবাজারের মদনমোহন মন্দিরের রাস দেখতে লোক উপচে পড়ত চিৎপুর রোড়ে। রাসমঞ্চের সামনে হত নাচ-গান, ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণে বড় দিঘির জলে চারটে নৌকা ভাসিয়ে তাতে কবিগানের আসর বসত, থাকত সঙ, কৃষ্ণলীলা বিষয়ে ছবি। এখনও হয় এই উৎসব। তবে আধুনিক শহরে প্রাচীন রাস-স্মৃতিই ভরসা।