সোনা, সম্পত্তির লোভেই পিসি শাশুড়িকে খুন, মধ্যমগ্রাম ট্রলি কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত মা ও মেয়ে
প্রতিদিন | ০১ নভেম্বর ২০২৫
অর্ণব দাস, বারাসত: সোনা ও সম্পত্তির লোভেই পিসি শাশুড়ি সুমিতা ঘোষকে খুন। শুক্রবার মধ্যমগ্রামের হাড়হিম করা ট্রলি কাণ্ডে মা আরতি ঘোষ ও মেয়ে ফাল্গুনী ঘোষকে দোষী সাব্যস্ত করল আদালত। আট মাসের মধ্যে শেষ হল বিচারপ্রক্রিয়া। আগামী সোমবার এই মামলার চূড়ান্ত রায় শোনাবেন বারাসত আদালতের সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা কোর্টের বিচারক প্রজ্ঞাগার্গী ভট্টাচার্য (হুসেন)।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মহিলার মৃতদেহ ট্রলি বন্দী করে কলকাতার গঙ্গার ঘাটে ফেলতে গিয়েছিল মা ও মেয়ে। কলকাতার উত্তর বন্দর থানার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় তারা। তদন্তে নেমে পুলিশের সামনে উঠে আসে একের এক চাঞ্চল্যক তথ্য। জানা যায়, বিবাহবিচ্ছেদের পর সুমিতা অসমে তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে থাকতেন। মৃতার ভাইপোর সঙ্গে বিয়ে হয় ফাল্গুনী ঘোষের। বিয়ের কয়েকমাস পরই ঝামেলা করে শ্বশুর বাড়ি থেকে মা অনিতার কাছে চলে আসে ফাল্গুনী। মা ও মেয়ে থাকত মধ্যমগ্রামের দক্ষিণ বীরেশপল্লী এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে।
এদিকে পিসি শাশুড়ি সুমিতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ফাল্গুনীর। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি সুমিতা অসম থেকে কলকাতায় বোন শিপ্রা ঘোষের বাড়িতে এসেছিলেন। ফাল্গুনীর কথা শুনে ওই দিনেই শিয়ালদহ থেকে মধ্যমগ্রামে এসেছিলেন সুমিতা। খুনের দু’দিন আগে পিসি শাশুড়ির ভাঙা সংসার জোড়া লাগানোর কথা বলে তিনজনে তাঁর প্রাক্তন স্বামীর বাড়ি বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর ২৩ ফেব্রুয়ারি অশান্তি হয় তাদের মধ্যে।
তখনই ভারী কিছু দিয়ে সুমিতার মাথায় আঘাত করে ফাল্গুনী। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে শ্বাসরোধ করে পিসি শাশুড়িকে খুন করে ফাল্গুনী ও তার মা অনিতা। এরপরই ধারালো বটি মুণ্ডু কেটে ফেলে তারা। খুনের পর সুমিতার দেহ থেকে সোনার গয়নাও খুলে ফেলে। সেগুলি মধ্যমগ্রামের একটি দোকানে ২ লক্ষ ৫৯ হাজার টাকায় বিক্রি করে ফাল্গুনী ও আরতি। দোকান থেকে নগদ ৩২ হাজার টাকা নিয়েছিল তারা। বাকি টাকার নিজের পছন্দ অনুযায়ী সোনার গয়না কিনেছিল ফাল্গুনী।
ঘটনার পর দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি পিসি শাশুড়ির লাশ ঘরে রেখেই ফাল্গুনী ও আরতি কলকাতায় আসে। বড়বাজার এলাকা থেকে কেনে ট্রলি। তাঁরা গিয়েছিল বউবাজারের একটি সোনার দোকানেও। সেই দোকানে ১ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকার সোনার গয়নার অর্ডার দিয়েছিল ফাল্গুনী। গয়নার অর্ডারের বিল করেছিল নিহত সুমিতার নামেই। নিহতের মোবাইল থেকে অনলাইনের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম পেমেন্টও করেছিল ফাল্গুনী। বাড়ি ফিরে হাতুড়ি দিয়ে পিসি শাশুড়ির দুটো পা ভেঙে ট্রলি বন্দী করে তারা।
২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে মা ও মেয়ে ভাড়া বাড়ির সামনে থেকে ভ্যানে করে মধ্যমগ্রামের দোলতলা পর্যন্ত নিয়ে আসে। সেখান থেকেই একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে আসে কলকাতার গঙ্গার ঘাটে। ট্রলি বের করে কুমোরটুলি গঙ্গায় ফেলার আগেই স্থানীয়দের সন্দেহ হওয়ায় আর ফেলতে পারেনি। নর্থ পোর্ট থানার পুলিশ এসেই ট্রলি কাণ্ডের রহস্যভেদ করে। খুনের অভিযোগে ফাল্গুনী ঘোষ এবং তার মা আরতি ঘোষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মামলার তদন্তভার নেয় মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ। মামলাটি ওঠে বারাসত আদালতে। ঘটনার পুনর্নির্মাণ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ-সহ ভ্যান, ট্যাক্সি চালক ও সোনার দোকানের মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ ফাল্গুনী ও আরতির বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় বারাসত আদালতে। মোট ৩২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১০৩(১) ও ২৩৮ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন বারাসত আদালতের সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা কোর্টের বিচারক প্রজ্ঞাগার্গী ভট্টাচার্য ( হুসেন)। সরকার পক্ষের আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা দ্রুত এই মামলার নিষ্পত্তি চেয়েছিলাম। মা ও মেয়ে দু’জনকেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন বিচারক।”