বিশ্বদীপ দে: ‘৯৯৭ বঙ্গাব্দে নিদাঘ শেষে এক দিন এক জন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতে ছিলেন।’ ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় একটি উপন্যাস। যার প্রথম লাইন ছিল এটাই। আমরা জানি, সেই উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’। লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখন তিনি তিরিশও পেরোননি। ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কে স্মরণে রেখেও এই উপন্যাস থেকেই বাংলা উপন্যাসের যাত্রা শুরু বলে মনে করা হয়। হয়তো উপন্যাস রচনার এই ধারাটিই পরবর্তী সময়ে মূলত অনুসৃত হতে থাকে বলেই। এরপর তিনি লিখেছেন একের পর এক উপন্যাস। কিংবা ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর মতো অভিনব প্রবন্ধ গ্রন্থ। পরবর্তী তিন দশকে বহুবিধ রচনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লিখে ফেলেন একটি গান। সংস্কৃত ও বাংলা মেশানো সেই গানই ‘বন্দে মাতরম’। এই বছর গানটির সার্ধশতবর্ষ। ফলে নতুন করে চর্চায় উঠে আসছে গানটি, আসছে দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খলমুক্ত করার সংগ্রামে গানটির আগ্নেয় ভূমিকার কথা! নিঃসন্দেহে বঙ্কিম আপামর জনতার কাছে এই গানটির রচয়িতা হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
বঙ্কিম কি জানতেন তাঁর এই গান এমনভাবে গৃহীত হবে? সম্ভবত জানতেন। জানা যায়, তিনি নাকি একবার বলেছিলেন, ”একদিন দেখবে, দেশ এই গানে মেতে উঠেছে।” তখনও ‘আনন্দমঠ’ লিখিত হয়নি। সেটা ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় নিজের বাড়িতে বসেই বঙ্কিম গানটি লিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৮৮২ সালে ‘আনন্দমঠ’-এর অংশ হয়ে ‘বন্দে মাতরম’ নতুন এক মাত্রা পায়। ধীরে ধীরে তা হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের মন্ত্র!
১৮৯৬ সালে বিডন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন। সেখানে গানটি পরিবেশন করেন খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ‘বালক’ পত্রিকায় গানটি প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে অবশ্য গানটি ‘দেশ’ রাগের বলে দাবি করা হয়। যদিও বঙ্কিমের ইচ্ছা ছিল গানটি গাওয়া হোক মল্লার রাগে। তবে শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে সুর ভেবেছিলেন তাতেও আপত্তি করেননি সাহিত্যসম্রাট। কিন্তু জনসমক্ষে গানটি যখন গাওয়া হল ততদিনে বঙ্কিম আর ইহজগতে নেই।
‘বন্দে মাতরম’-এ কি ভারতমাতাকে সম্বোধন করা হয়েছে? নাকি আসলে এখানে ‘বঙ্গমাতা’র কথা বলা হচ্ছে? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাকি সুবর্ণ বসু তাঁর বইয়ে দাবি করেছেন, বঙ্কিম এখানে বঙ্গমাতার কথাই বলেছিলেন। যদিও গানে সরাসরি সেকথা বলা নেই। তবু ‘সপ্তকোটি’ সংখ্যাটি আসলে বঙ্গদেশের জনসংখ্যাকে প্রকাশ করছে! এমনটাই মনে করছেন নেতাজির পৌত্র। মনে রাখতে হবে, ঋষি অরবিন্দ ঘোষও গানটিকে ‘বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত’ বলেছিলেন। তবে লেখার সময় বঙ্কিমের উদ্দেশ্য যাই থাকুক, শেষপর্যন্ত এই গান কেবল বাংলায় আবদ্ধ থাকেনি। বরং তা হয়ে উঠেছে পরাধীন এক দেশের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষার তীব্র দাবির অমোঘ একক।
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের পর ফের কংগ্রেসের অধিবেশনে গানটি গাওয়া হয়েছিল ১৯০৫ সালে। সেবার গানটি গেয়েছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানি। তিনি রবীন্দ্রনাথের দিদির মেয়ে। এদিকে লাহোর থেকে ‘বন্দে মাতরম’ নামে পত্রিকাই বের করে ফেলেন লালা লাজপত রায়। আর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রুখতে টাউন হলে যে জমায়েত হল সেখানে আকাশ-বাতাস মাতিয়ে দিল এই ধ্বনি। রাতারাতি সেই গান বাংলার পরিধি ছাড়িয়ে এক অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়ল দেশভর। দ্রুত ব্রিটিশরা অনুভব করল সেই স্লোগানের শক্তি। ফলে জনসমক্ষে ‘বন্দে মাতরম’ বললেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল। কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি আমজনতাকে। এক স্ফূলিঙ্গ থেকে অন্য স্ফূলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া আগুনের মতোই ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অগ্নিসংযোগ করেই চলেছিল এই ধ্বনি। হয়ে উঠছিল এক অসীম শক্তিশালী মন্ত্র।
বোস রেকর্ড ও নিকোল রেকর্ড কোম্পানির মতো সংস্থা রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গীত ‘বন্দে মাতরম’-এর রেকর্ডও প্রকাশ করে। কেবল রবীন্দ্রনাথ নয়, বাজারে এসে গিয়েছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যভূষণ গুপ্ত, আর এন বোস প্রমুখদের গাওয়া ‘বন্দে মাতরম’ও। ১৯০৭ সালে হেমেন্দ্রমোহন বোস একেবারে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই প্রকাশ করেছিল রেকর্ড। খবর পেয়েই কারখানাতেই হাজির পুলিশ! তারা কারখানা গুঁড়িয়ে দিল। নষ্ট করে ফেলা হল সমস্ত ‘বন্দে মাতরম’-এর রেকর্ড। যদিও পরে দেখা যায় বেলজিয়াম ও প্যারিসে রয়ে গিয়েছে কয়েক কপি! যা বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে ছড়িয়েছিল অগ্নিমন্ত্রের দাবানল!
১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি। সংবিধান কমিটির সভায় রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘোষণা করে দেন, ‘জনগণমন’ হবে জাতীয় সঙ্গীত। এবং ‘বন্দে মাতরম’ হবে জাতীয় স্ত্রোত্র। এরপরও কেটে গিয়েছে সাড়ে সাত দশক। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই গান আজও রয়েছে। কেবলই ঐতিহাসিক কিংবা গবেষণার প্রয়োজনে নয়। বরং এ আর রহমানের মতো সুরকারও ফিরে ফিরে গিয়েছেন গানটির কাছে। যা প্রমাণ করে দেয়, বঙ্কিম আসলে একজন ক্রান্তদর্শী মানুষ। সেই কবে তিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘একদিন দেখবে, দেশ এই গানে মেতে উঠেছে।” ভুল বলেননি তিনি। বঙ্কিমের উপন্যাসগুলি যেন পুনঃপঠিত হয়ে চলেছে, তেমনই ‘বন্দে মাতরম’ও ধ্বনিত হয়ে চলেছে এই দেশের আকাশে বাতাসে।