• আলোর শহরে গৃহস্থালি ডুবত ‘অন্ধকারে’! চন্দননগরে বদলাল সেই প্রথা, এ বার জগদ্ধাত্রীর শোভাযাত্রা বিদ্যুৎ সচল রেখেই
    আনন্দবাজার | ০২ নভেম্বর ২০২৫
  • দস্তুর বদলাল! এ বার ঘরেও আলো, বাইরেও আলো। শোভাযাত্রার দিনে চন্দননগরের কোনও ঘরই আর লোডশেডিংয়ে ডুবল না। জলের জোগানও অবিরত।

    এতকাল জগদ্ধাত্রীপুজোর শোভাযাত্রার দিন অনেক ক্ষণের জন্য কার্যত ‘শাটডাউন’ হয়ে যেত গোটা চন্দননগর। প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হত সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। দশমী এবং একাদশীতে এই ভাবে বিদ্যুৎহীন হয়ে থাকা কার্যত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল গোটা শহরবাসীর কাছে। কিন্তু এ বছর সেই প্রথা ভাঙল।

    শনিবার সকাল থেকেই প্রতিমা নিরঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে চন্দননগরে। কিন্তু এখনও (এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত) শহরে কোথাও লোডশেডিং হয়নি। এতে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন শহরের বাসিন্দারা, মূলত যাঁরা আবাসনে থাকেন। চন্দননগরের বড়বাজারে একটি আবাসনে থাকেন পেশায় শিক্ষক অভিষেক ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘এত বছর ধরে ভাসানের দু’দিন লোডশেডিং হয়ে থাকত গোটা চন্দননগরে। নানা সমস্যায় পড়তে হত। এ বার কিন্তু লোডশেডিং হয়নি। সকাল থেকেই কারেন্ট আছে।’’

    চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের উচ্চতাই হয় অন্তত ২০-২৫ ফুট করে। সেগুলি বড় বড় ট্রাকে তুলে শোভাযাত্রা সহকারে গঙ্গার ঘাটে বিসর্জন দিতে যাওয়া হয়। বিসর্জনের সময় বিদ্যুতের ওভারহেড তারে প্রতিমার কোনও অংশ ঠেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ রাখা হত চন্দননগরে।

    এই সমস্যা নজরে রেখে দু’বছর আগে মাটির নীচ দিয়ে বিদ্যুতের তার বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল চন্দনগরে। ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেই প্রকল্পের কাজ সম্প্রতিই শেষ হয়েছে। ১১ হাজার কেভির বিদ্যুতের লাইনের প্রায় পুরোটাই মাটির তলা দিয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুজোর আগে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করেছিলেন। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রীপুজোর প্রস্তুতি বৈঠকে স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের তথ্যসংস্কৃতি দফতরের প্রতিমন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন নিজেই জানিয়েছিলেন, এ বছর থেকে আর ভাসানের দু’দিন লোডশেডিং হবে না।

    আর শুধু যে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া, তা-ও নয়। আনুষঙ্গিক নানা পড়তে হত শহরবাসীকে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল জলের সমস্যা। লক্ষ্মীগঞ্জের বাসিন্দা কাকলি দত্ত বলেন, ‘‘লোডশেডিং হওয়াটা বড় ব্যাপার ছিল না। এ বছর পুজো খানিক আগে হল। কিন্তু অন্যান্য বছর অক্টোবরের শেষে পুজো হয়। তখন শীতের আমেজ পাওয়া যায়। ফলে গরমে পাখা চালানোর ব্যাপার ছিল না। সমস্যা থাকত মূলত জল নিয়ে। সারা দিন জল পাওয়া যেত না।’’

    জলের সমস্যা মেটাতে পুরসভার গাড়ি পাড়ায় পাড়ায় যেত ঠিকই। কিন্তু চাহিদা আর তাতে কতটুকুই বা মেটে! বিবিরহাটের শুভজিৎ সেন বলেন, ‘‘আমরা যারা আবাসনে থাকি, তাদের আরও বেশি সমস্যায় পড়তে হত। জল তুলে রাখতে হত আগের দিন। এ ছাড়াও রান্নাবান্না, ফোনে চার্জ দেওয়ার সমস্যা তো ছিলই। এ বার এখনও পর্যন্ত সে রকম কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি।’’

    চন্দননগরের মেয়র রাম চক্রবর্তীও আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘‘গত বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বন্ধ থাকার কারণে যে সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়েছে, এ বার তা হবে না। জগদ্ধাত্রীপুজোর সময় চন্দননগরে অনেক গৃহস্থের বাড়িতেই আত্মীয়স্বজনেরা আসেন। সেই সব বাড়িতে স্বাভাবিক ভাবেই বেশি জলের প্রয়োজন। ওরা ভীষণ সমস্যায় পড়ত। সব দিক নজরে রেখে এই চিরস্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটা হয়েছে।’’

    চন্দননগরে ভাসানের দিনে লোডশেডিং মূলত দিনের বেলায় হত। মণ্ডপ থেকে প্রতিমা বার করে তা জিটি রোড পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। দিনের এই সময়টুকুতেই বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হত শহরে। সন্ধ্যায় জিটি রোড ধরে শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার পর অবশ্য ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে আসত। বিদ্যুৎ দফতরের হুগলি আঞ্চলিক ম্যানেজার মধুসূদন রায় বলেন, ‘‘এই প্রথম বিদ্যুৎ চালু রেখে প্রতিমা বিসর্জন হবে। তাই সব যাতে ঠিকঠাক ভাবে মেটে, সেটা দেখতে হবে।’’

    শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার কথা। ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলা বারোয়ারি শোভাযাত্রায় যোগ দিলে মোট পুজো কমিটির সংখ্যা দাঁড়াবে ৭০। সে ক্ষেত্রে মোট ট্রাকের সংখ্যা হবে ২৪৫। এই ট্রাক-ম্যাটাডোরেই শোভাযাত্রার আলো সাজানো হয়।

    চন্দননগর কমিশনারেট জানিয়েছে, শোভাযাত্রাকে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে হাজার তিনেক পুলিশকর্মী পথে থাকবেন। কমিশনারেটের এক কর্তা জানান, প্রতিটি কমিটির সঙ্গে পুলিশের একটি দল হাঁটবে। মহিলাদের নিরাপত্তায় বিশেষ পুলিশি বন্দোবস্ত থাকবে। ড্রোন ওড়ানো হবে। সিসিটিভিতেও নজরদারি চলবে।এ বছরেও রাজ্য সরকার শোভাযাত্রার সরাসরি সম্প্রচার করবে অনলাইনে। অতিথিদের বসার জন্য কমিশনারেটের পক্ষ থেকে থানার সামনে স্ট্র্যান্ডে বড় মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।

    পুরসভা সূত্রের খবর, শোভাযাত্রায় থাকা পুজো কমিটিগুলি রবিবার সকাল থেকে গঙ্গার ঘাটে-ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন দেবে। তবে, যে সমস্ত পুজো কমিটি শোভাযাত্রায় যোগ দেবে না, তাদের অনেকেই শনিবার সকাল থেকে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া শুরু করবে। মেয়র জানান, চন্দনগর ও ভদ্রেশ্বরে সাতটি করে মোট ১৪টি ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন হবে। সেইমতো ঘাটগুলির সামনে গঙ্গায় জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রতিমা বিসর্জন হয় চন্দননগরের রানিঘাটে। সেখানে সর্বোচ্চ পাঁচটি ট্রাক দাঁড়ানোর জন্য দাগ দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)