গত কয়েক মাস ধরেই উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে সিএএ সহায়তা শিবির চালাচ্ছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এবং বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুরের মতো বিজেপি নেতা। সেখানে অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের পরিচয়পত্র, হিন্দুত্বের শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে (সিএএ) আবেদনের করার ব্যবস্থাও আছে। এই সমস্ত কাজই টাকার বিনিময়ে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠল। অভিযোগ, এ সবের জন্য ‘রেটচার্ট’ও তৈরি হয়েছে। যেমন ৩০ টাকায় মতুয়া-পরিচয়পত্র, ৫০ টাকায় ফর্ম ফিলআপ এবং ৮০০ টাকায় হলফনামার ব্যবস্থা যা নাগরিকত্ব পেতে সাহায্য করবে বলেই দাবি!
এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরেই বিজেপির বিরুদ্ধে মতুয়াদের নিয়ে ব্যবসা করার অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে তৃণমূল। শাসকদলের প্রশ্ন, এক জন জনপ্রতিনিধি কি এ ভাবে সাধারণ নাগরিকদের থেকে টাকা চাইতে পারেন? তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘‘নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার নামে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি বিধায়কেরা কী করে টাকা চাইছেন? এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত দলের। তবে গোটা বিষয়টি আইনবহির্ভূত বলেই মনে হচ্ছে।’’ তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিজেপির বিধায়কেরা টাকার বিনিময় নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন! নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গভীর যোগসাজস না থাকলে এই ধরনের ঘটনা ঘটত না।’’
এ ব্যাপারে বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনুর সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার ডট কম। শান্তনু বলেন, ‘’আমরা যে সিএএ সহায়তা শিবির চালাচ্ছি, সেখানে এ রকম কিছু হচ্ছে না। শিবির অন্যান্যরাও খুলেছেন। তাঁরা কে কী করছেন, আমার জানা নেই।’’
গাইঘাটার বিধায়ক সুব্রত টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘‘আমি বা আমরা কেউ টাকা নিচ্ছি না । যাঁরা এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করছেন, টাকাটা তাঁরাই নিচ্ছেন। যাঁরা অভিযোগ তুলছেন, তাঁরা আসলে চান না, উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পান। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভয় তৈরি করতে চাইছেন তাঁরা। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষকে সঠিক দিশা দেখানো।’’
দেশে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকেই ঠাকুরনগরে সিএএ সহায়তা শিবির চালু করেছিলেন শান্তনু-সুব্রতেরা। দেশে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর নিয়ে তোড়়জোড় শুরু হওয়ার পরেই সেই সব শিবিরে ভিড় একটু একটু বাড়ছিল। সম্প্রতি এ রাজ্যে এসআইআর-এর দিনক্ষণ ঘোষণা হয়েছে। ঘটনাচক্রে, ঠিক তার পরেই শান্তনু-সুব্রতদের শিবিরে টাকা নিয়ে শংসাপত্র দেওয়ার অভিযোগ উঠল।
ঠাকুরনগরে শান্তনু এবং সুব্রত দু’জনে দু’টি শিবির চালাচ্ছেন। শান্তনু-শিবিরে থাকা মতুয়া মহাসংঘের এক নেতার দাবি, ‘‘সিএএ আবেদন পূরণের জন্য ১৮০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৩০ টাকা সদস্যকার্ডের জন্য, ৫০ টাকা আবেদনপত্র পূরণের জন্য আর ১০০ টাকা অনুদান হিসেবে। আর যাঁরা সিএএ-র আওতায় নাগরিকত্ব পেতে সাহায্য করছেন, তাঁদের জন্য ৮০০ টাকা দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে খরচ ৯৮০ টাকা। এর মধ্যে আদালতের হলফনামার খরচ ধরা রয়েছে।’’ আবার সুব্রতের শিবিরে মতুয়া সদস্যের কার্ডের জন্য লাগছে ৩০ টাকা। ৫০ টাকা লাগছে নাগরিকত্বের ফর্ম ফিল আপের জন্য। আর ৮০০ টাকা লাগছে আদালতের হলফনামার জন্য। সব মিলিয়ে ৮৮০ টাকা।
ঠাকুরনগরে সুব্রতের সিএএ সহায়তা শিবিরে গিয়ে দেখা গেল, একদল তরুণ-তরুণী ল্যাপটপ, কম্পিউটার নিয়ে বসে মতুয়াদের ফর্ম দেওয়া এবং ফর্ম ফিল আপের কাজকর্ম করছেন। তাঁদের দাবি, ‘‘অন্যান্য শিবির থেকে করা নাগরিকত্বের আবেদন বাতিল হলেও, আমাদের মাধ্যমে জমা দেওয়া একটি ফর্মও বাতিল হয় না। এই কারণেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসছেন।’’
বাস্তবে তেমনটাই দেখা গেল। এসআইআর নিয়ে শোরগোলের আবহে মতুয়াদের আনাগোনা বেড়েছে সিএএ সহায়তা শিবিরে। তবে টাকা নিয়ে নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টিতে ক্ষোভও তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। নদিয়ার কৃষ্ণনগর দক্ষিণ বিধানসভা এলাকা থেকে সুব্রতের শিবিরে যাওয়া প্রভাত টিকাদার বলেন, “আমাদের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ দীর্ঘ দিন ধরে যে আন্দোলন করেছেন, আজকের নেতৃত্ব সেই ইতিহাস ভুলে কেবল রাজনীতি করছেন আর টাকা কামাচ্ছেন!’’
সুব্রতের অবশ্য সাফাই, ‘‘হ্যাঁ, ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কারণ হলফনামা সংক্রান্ত কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে হয়।’’