• অপর্ণা না হরনাথ? আলিমুদ্দিনে জোর লড়াই! কার চিত্রনাট্যে পরের ছবি বানাবে সিপিএম?
    আনন্দবাজার | ০২ নভেম্বর ২০২৫
  • কেউ চাইছেন ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’। কেউ ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’। জোর লড়াই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে! অপর্ণা সেন না হরনাথ চক্রবর্তী? ‘ক্লাস’ নাকি ‘মাস’?

    সদ্যই আশি বছরে পা রেখেছেন অপর্ণা। এই জীবনকালে তিনি একাধিক ছবি পরিচালনা করেছেন। কিন্তু সবসময়েই তাঁর ছবি থেকেছে সমাজের নির্দিষ্ট অংশের জন্য। পক্ষান্তরে, হরনাথ বরাবর চলেছেন ‘গণলাইন’ মেনে। যে যাঁর রাস্তায় ঠিক। দু’জনেই তাঁদের নিজেদের দর্শনে স্থির। বাস্তবে তাঁদের মধ্যে কোনও লড়াই নেই। কিন্তু তাঁদের দর্শন নিয়ে লড়াই বেধেছে সিপিএমের অন্দরে। লড়াই আগামী বিধানসভা ভোটে খাতা খোলার।

    সিপিএমের একাংশ চাইছে, নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনকে চিহ্নিত (ফোকাস) করে লড়ে অন্তত খাতা খোলা হোক। যেমন দর্শনে বিশ্বাস করেন পরিচালক অপর্ণা। বাকিরা চান হরনাথ লাইনে চলতে। কারণ, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু আসনে মনোনিবেশ করলে বিজেপি নামক ‘বড় বিপদ’ ঘাড়ে চেপে বসবে। তাই সর্বত্রই গুরুত্ব দিয়ে ভোটের লড়াই হোক। ‘ক্লাস’ দরকার নেই। আপাতত ‘মাস’ সঙ্গে থাকুক।

    প্রথম মতবাদের পক্ষে যুক্তি, সব দিক দেখার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই। সেটা মেনে নিয়েই মাঠে নামা উচিত। অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু আসন চিহ্নিত করে লড়া উচিত। যাতে ‘শূন্যগ্রহণ’ থেকে দলকে মুক্ত করা যায়। তাঁদের এ-ও আশঙ্কা যে, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটেও খাতা না-খোলা গেলে বহু এলাকায় দলীয় কাঠামো টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হবে। প্রসঙ্গত, বঙ্গ সিপিএম আগেই রীতি ভেঙে পেশাদারদের নিয়োগ করেছে। তাঁদের সমীক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জেলা এবং আসনের তালিকাও তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী তলায় তলায় সাংগঠনিক ক্রিয়াকলাপও চলছে।

    অন্যদের পাল্টা ব্যাখ্যা, গত লোকসভা ভোটেও দেখা গিয়েছে, বেশ কিছু আসনে বামেদের ভোটের জন্য বিজেপি-কে আটকানো গিয়েছে। তৃণমূল জিতলেও রোখা গিয়েছে বিজেপি-কে। তাঁদের আরও যুক্তি, সার্বিক গুরুত্ব দিয়ে লড়াই না করলে ভোট শতাংশ আরও কমে যাবে। আসন জিততে না-পারলে আম-ছালা দুই-ই যাবে।

    সিপিএমের মধ্যে যাঁরা ‘হরনাথপন্থী’, তাঁদের মতিগতিকে নিয়মিত নিশানা করছে বিজেপি। সম্প্রতি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী হিসাব দিয়ে দাবি করেছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে যদি দমদমে সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী দু’লক্ষের বেশি, ব্যারাকপুরে দেবদূত ঘোষ এক লক্ষের বেশি ভোট না পেতেন, তা হলে ওই দু’টি আসনেই বিজেপি জিতত। শুভেন্দুর অভিযোগ, বামেরা নিজেদের নাক কেটে রামের যাত্রা ভঙ্গ করেছে। ফায়দা হয়েছে তৃণমূলের। খানিকটা সেই সুরেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যও বলেছেন, ‘‘সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের কাছে আবেদন করব, বুকে পাথর চেপে হলেও পদ্মফুলে এ বার বাঁ’হাতে বোতামটা টিপুন। রাজ্যটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান।’’

    আনুষ্ঠানিক ভাবে সিপিএম নেতারা অবশ্য দুই লাইনের দ্বন্দ্ব বা ধন্দ নিয়ে কোনও মন্তব্য করছেন না। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন যেমন বলেছেন, ‘‘বামেরা ছাড়া রসাতলে যাওয়া বাংলাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’’ তবে মুখে না-বললেও সুজনও সম্ভবত মনে মনে জানেন, বাংলার কী হবে তা পরের কথা। সিপিএম বাঁচলে তবে তো বাংলার নাম। আগে ‘শূন্যগ্রহণ’ কাটাতে হবে আলিমুদ্দিনকে।

    নভেম্বর থেকে দলের ঝান্ডা নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ পদযাত্রা করবে সিপিএম। এমন যাত্রা ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগেও করেছিল তারা। সে যাত্রায় সামনের সারিতে ছিলেন দলের যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। ব্রিগেডের সমাবেশে ভিড়ও উপচে পড়েছিল। কিন্তু সেই ভিড় ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হয়নি। পর পর তিনটি বড় ভোটে শূন্যের ধারা বজায় রেখেছে বামেরা। আরও একটি বড় ভোট আসন্ন। তার আগে সিপিএম উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ার মতো কিছু জেলার কিছু আসনকে ‘বাড়তি গুরুত্ব’ দিচ্ছে। পাশাপাশি এই তালিকায় লড়াইয়ের জায়গায় থাকার মতো হুগলি ও কলকাতার গোটা চার-পাঁচেক আসন রয়েছে সিপিএমের খেরোর খাতায়। এই সব আসনের সমীকরণের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে কংগ্রেসের ভোটও। সেই কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের আদৌ নির্বাচনী বোঝাপড়া হবে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়।

    সে না-হয় যখন স্পষ্ট হওয়ার হবে। কিন্তু ভোটের দর্শন কী হবে? হরনাথ না অপর্ণা? ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ না ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’?

    তৃণমূল অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। শাসকদলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘সিপিএম এখন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘খাদ’-এর কিনারায়। ওরা যতই অপর্ণা সেন বা হরনাথ চক্রবর্তীর লাইন নিয়ে আলোচনা করুক, ভোটের পরে সেই কৌশিকের ছবিতেই ফিরতে হবে—শূন্য এ বুকে।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)