অরূপ লাহা: এসআইআর (SIR) আতঙ্কে আবারও মৃত্যু। তামিলনাড়ুতে পরিযায়ী শ্রমিক বিমল সাঁতরার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক তরজার পারদ উর্ধ্বমুখী। মৃতের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের নবগ্রামের উড়িষ্যা পাড়ায়। শনিবার প্রশাসনের উদ্যোগে বিমল সাঁতরার মৃতদেহ তাঁর বাড়িতে পৌঁছায়। এরপরই সেখানে যান রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ ও তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের নির্দেশে তাঁরা বিমলবাবুর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সমবেদনা জানান।
ঘটনা নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব সরাসরি নির্বাচন কমিশনকে দায়ি করেছেন। মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, 'এসআইআরের আতঙ্কে আরও একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। এর জন্য দায়ী নির্বাচন কমিশন।'
তৃণমূল জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, 'বিমল সাঁতরা এসআইআরের আতঙ্কে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন।'
শোকস্তব্ধ পরিবার, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিজনরা। পূর্ব বর্ধমানের (East Burdwan) জামালপুরের নবগ্রাম উড়িষ্যা পাড়ায় নেমেছে শোকের ছায়া। মৃত বিমল সাঁতরার (Biman Santra) পরিবারের অভিযোগ, এসআইআর-এর আতঙ্কেই প্রাণ দিলেন তাঁদের প্রিয় মানুষটি। মৃতের ছেলে বাপি সাঁতরার দাবি, এসআইআর আতঙ্কে বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই আতঙ্কেই বাবার মৃত্যু হয়েছে।
পরিবারের দাবি, গত কয়েকদিন ধরেই ওই এসআইআর বারবার বিমলবাবু ভয়ে ছিলেন। মানসিক চাপই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে অভিযোগ। মৃতের ছেলে বলেন, 'বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। এসআইআর-এর ভয়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।'
এই ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। প্রতিবেশীরাও প্রশাসনের কঠোর তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। যদিও পুলিস সূত্রে দাবি, মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
বাপি তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর (Thanjavur) জেলার ওরাতানাডু (Orathanadu) থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেন। শুক্রবার সেখানকার স্থানীয় হাসপাতালে দেহর ময়নাতদন্তও হয়। এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনীতিও শুরু হয়েছে।
তামিলনাড়ু পুলিসের চালান থেকে জানা যায়, গত ২৬ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বিমল সাঁতরা। সেখানে কয়েক দিন ভর্তি থাকার পরে বৃহস্পতিবার বিমলের মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় শনিবার সন্ধ্যায় দেহ গ্রামে আসে। সে সময় গ্রামে হাজির ছিলেন জামালপুরের বিধায়ক অলোক মাঝি থেকে তৃণমূলের নেতারা।
মৃতের ছেলের দাবি, বাবা ধান রোয়াতে তামিলনাড়ুতে গিয়েছিলেন। এসআইআর ঘোষণার পর বাবা চিন্তায় ছিলেন। এসআইআর হলে ভোটার তালিকায় নাম থাকবে কি না, সে নিয়ে চিন্তা করতেন। ওই আতঙ্কেই বাবা অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন।
বিধায়কের দাবি, প্রায় আড়াই বছর ধরে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। সে কারণে ধান রোয়ার জন্য ভিন রাজ্যে কাজে যাচ্ছেন। এসআইআর নিয়ে উনি (বিমল) ভয়ে ছিলেন। চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
বিজেপির জামালপুর ১ নম্বর মণ্ডলের সভাপতি প্রধানচন্দ্র পাল বলেন, যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। এসআইআর এর জন্য নয়, অন্য কারণে মৃত্যু হয়েছে। তৃণমূল পায়ের তলার মাটি হারিয়ে উল্টোপাল্টা বলছে।
গ্রামে এখন শোকের ছায়া। বিমলবাবুর হঠাৎ মৃত্যুতে স্তব্ধ নবগ্রাম উড়িষ্যা পাড়া। স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন— 'যদি সত্যিই আতঙ্কেই মৃত্যু হয়, তবে দায় কার?'
এর আগে, পানিহাটিতে ৬০ বছর বয়সী প্রদীপ কর NRC ও SIR আতঙ্কে আত্মহত্যা করেন বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিল, উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির মহাজাতি নগরের বাসিন্দা প্রদীপ কর SIR আতঙ্কের জেরে আত্মহত্যা করেন। সোমবার নিজের ঘরেই আত্মঘাতী হন প্রদীপবাবু। এমনটাই দাবি প্রতিবেশীদের।
২০০২ সালে ২১৪ নং বুথের ভোটার ছিলো প্রদীপ বাবুর। বেডিং এর ব্যবসা করতেন প্রদীপ বাবু। প্রদীপ বাবুর ভগ্নিপতি উত্তম হাজরা জানাচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরেই তিনি পানিহাটি বিধানসভার ভোটার ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে খবর, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিবেশীরা দেখেন, গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছেন প্রদীপ কর। মৃতদেহের পাশে ছিল একটি ডায়েরি। সেই ডাইরিতে লেখা এনআরসি সম্পর্কিত বিষয়। ডায়েরির খাতার একদম নিচে লেখা, 'এনআরসি আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী'। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হয় খড়দহ থানার পুলিস। প্রদীপবাবুর মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। ঘটনার তদন্ত শুরু করে খড়দহ থানার পুলিস।
এছাড়া, কোচবিহারেও এক জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এর আগে এসআইআর আতঙ্কে! পরিবারের দাবি, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নামের বানান ভুল থাকায় তা নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন বছর ষাটের ওই বৃদ্ধ।
দিনহাটার বাসিন্দা খাইরুল শেখ বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ভোটার তালিকায় নামের বানান ভুল থাকায় খাইরুল আতঙ্কে ছিলেন বলে প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছে পুলিস। সন্দীপ বলেন, ‘‘ওঁর নাম খাইরুল শেখ। কিন্তু ভোটার তালিকায় তার নাম খয়রু শেখ লেখা আছে। এই নিয়ে তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই চিন্তিত ছিলেন বলে জানতে পেরেছি।’
পুলিস সুপার আরও জানিয়েছেন, গ্রামবাসীদের দাবি, খাইরুল এসআইআর ঘোষণার পর থেকে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আপাতত তিনি কোচবিহার জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি একটু সুস্থ হলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সন্দীপ। একই কথা বলেন দিনহাটার এসডিপিও ধীমান মিত্রও। তাঁর কথায়, ‘‘উনি সাহেবগঞ্জ থানা এলাকার বাসিন্দা। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, উনি এসআইআর-এর কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। উনি তো কোচবিহারের হাসপাতালে ভর্তি। আমরা তদন্ত করে দেখছি।
দিনহাটার বুড়িরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের জিতপুর এলাকার বাসিন্দা খাইরুল। স্থানীয় সূত্রে খবর, বুধবার সকালে তিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরেই তাঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তিনি খানিক কথা বলতে পারছেন। ওই অবস্থায় খাইরুল বলেন, ‘আমার নামের বানান ভুল ছিল। আমার নাম বাদ চলে যাবে, এই ভয় পাচ্ছিলাম। তাই বিষ খেয়ে নিয়েছি।’
রাজ্যে আরও একটি আত্মহত্যার ঘটনা হয়েছে! SIR আতঙ্কে মৃত্যু বলে অভিযোগ। পশ্চিম মেদিনীপুরের কোতোয়ালির ক্ষিতীশ চন্দ্র মজুমদারের মৃত্যুতে রাজনৈতিক চাপানউতোর তুঙ্গে।
SIR নিয়ে মামলাও দায়ের হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। এসআইআর নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়েরের অনুমতি চেয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ। মামলা দায়েরের অনুমতি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সুজয় পালের ডিভিশন বেঞ্চের। তবে এই জল কতদূর গড়ায় এখন তা-ই দেখার।