এই সময়: বন্দুক রাজনৈতিক নেতাদের। নিশানা প্রতিপক্ষের দিকে। তবে ঘাড়টা বুথ লেভেল অফিসারদের (বিএলও)!
কার্যত তাঁদের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই বাংলার যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলি ‘সার–যুদ্ধ’ শুরু করে দিয়েছে। ঘনিষ্ঠ মহলে তৃণমূল–বিজেপি দু’পক্ষই একটি বিষয়ে একমত যে, ‘সার–পর্বে’ প্রতিপক্ষর দিকে বন্দুক তাক করতে গেলে কারও না কারও ঘাড়ে বন্দুক রাখতেই হবে। এই মুহূর্তে বিএলও–দের ঘাড়ই ‘বেস্ট অপশন’।
স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন অথবা ‘সার’–এর প্রস্তুতি পর্ব থেকেই বিএলও–দের নিশানা করে তৃণমূল বার্তা দিতে শুরু করেছে বিজেপিকে। রাজ্যের শাসক দলের হুঁশিয়ারি, ‘সার’–এর সময়ে বিএলওদের মাথায় রাখতে হবে, এক জন বৈধ ভোটারের নামও যেন তালিকা থেকে বাদ না পড়ে। তৃণমূলের তরফে বিএলও–দের নিয়মিত স্মরণ করানো হচ্ছে, দিনের শেষে তাঁরা আদতে রাজ্য সরকারি কর্মচারী।
অন্যদিকে, বিজেপির হুমকি, এক জন অনুপ্রবেশকারীর নামও ভোটার তালিকায় থাকলে বিএলও–দের জেলে পুরে দেওয়া হবে। যেমন হয়েছে বিহারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএলও–দের ঘাড়ে বন্দুক রাখলেও আসল টার্গেট তাঁরা নন। দু’পক্ষেরই নিশানায় প্রতিপক্ষ। কিন্তু নিশানা যাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়, তার জন্য বন্দুকটা রাখা হচ্ছে বাংলার আশি হাজারেরও বেশি বিএলও–দের ঘাড়ে। ‘সার’ পর্বে বস্তুত তাঁরাই হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক দলগুলির ‘সফট টার্গেট’।
শাসক–বিরোধী দু’পক্ষই আপাতত বিএলও–দের সঙ্গে প্রতিপক্ষের যোগসূত্র খুঁজতে ব্যস্ত। ফলে প্রশ্ন উঠছে বিএলও–দের নিরাপত্তা নিয়েও। রাজনৈতিক দলগুলি–ই যদি তাঁদের এ ভাবে দাগিয়ে দেয়, তবে কীসের ভরসায় বিএলও–রা ৪ তারিখ থেকে এনিউমারেশন ফর্ম নিয়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ছুটবেন? এই চাপ ইতিমধ্যে বিএলও–রাও সম্যক অনুভব করতে পেরেই শনিবার তাঁদের প্রশিক্ষণের সময়ে নিরাপত্তার কথা উত্থাপন করেছেন।
প্রকাশ্যে না হলেও ঘনিষ্ঠ মহলে বাংলার অনেক রাজনীতিকই বিএলও–দের ঘাড়ে এই বন্দুক রেখে চালানোর বিষয়টি স্বীকার করে নিচ্ছেন। তাঁদের মতে, প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতেই বিএলও–দের নিশানা করা হচ্ছে। এক প্রবীণ বিজেপি নেতার কথায়, ‘এটা আমাদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। আসলে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বহু জায়গায় আমাদের বুথ লেভেল এজেন্ট (বিএলএ) নেই। সেখানে ভোটার তালিকায় কারচুপি করার চেষ্টা করবে তৃণমূল। সেটা ঠেকাতে পারেন একমাত্র বিএলও।’ তাঁর সংযোজন, ‘কোনও সন্দেহ নেই তৃণমূলের তরফে তাঁদের (বিএলও) উপরে প্রবল চাপ আসবে। তাই আমরাও আগেভাগে বিএলও–দের উপরে চাপ তৈরি করে রাখছি। যাতে তৃণমূলের চাপের কাছে নতিস্বীকার করার আগে বিজেপির হুমকিগুলির কথা তাঁদের মনে পড়ে যায়।’
প্রায় একই যুক্তি তৃণমূল নেতাদের একাংশেরও। জোড়াফুল শিবিরের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘নির্বাচন কমিশন বিজেপির হাতের পুতুল। তাই কমিশনকে ঢাল করে বিজেপি ভোটার তালিকা থেকে নিজেদের অপছন্দের নামগুলি বাদ দিতে চাইছে। বিএলও–রা রাজ্য সরকারি কর্মচারি হলেও এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। সেই সুযোগটাই বিজেপি নিচ্ছে। তারা বিএলও–দের জেলে পাঠানোর ভয় দেখিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই আমরা বিএলও–দের হুঁশিয়ারি দিচ্ছি। যাতে বিজেপির হুমকির থেকেও আমাদের হুঁশিয়ারি তাঁদের কাছে বেশি জোরদার মনে হয়।’
বাংলার প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের গতিবিধি থেকে স্পষ্ট, ‘সার’ প্রক্রিয়া যত এগোবে, ততই বিএলও–দের উপরে ঝড়–ঝাপটা বাড়বে। কারণ, তাঁদের ঘাড়েই যে রাজনৈতিক দলগুলির বন্দুক। বিএলও–দের একাংশ অবশ্য নিজেদের ঘাড় নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। উত্তর ২৪ পরগনার এক বিএলও–র কথায়, ‘ভোটার তালিকা ঝাড়াই–বাছাই করার গুরু দায়িত্ব আমাদের উপরে। তাই দু’পক্ষই আমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কাজ হাসিল করতে চাইছে। এনিউমারেশন ফর্ম নিয়ে আমরা যখন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাব, তখন কোনও সমস্যা তৈরি হলে নেতারা নিরাপদ দূরত্বেই থাকবেন। অথচ তাঁদের ক্রস ফায়ারিং–এর মধ্যে সব থেকে অসুরক্ষিত আমরাই।’