‘হামনি কে বিকাশ না হোলাই। গাঁও কা হিস্সা তো হামু হোলাই!’
সেকি? বলে কী লোকটা? তেল চকচকে রাস্তা। সোলার লাইট। স্কুল। ব্যাঙ্ক। সঙ্গে এটিএম। হাতের কাছে হাসপাতাল। ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ। শান্ত স্নিগ্ধ ছবির মতো গ্রাম। তাও বিকাশ নেই! এগুলো বিকাশ না হলে, আর কী চাই এদের?
গ্রামের নাম ‘কল্যাণ বিগহা’। জেলা নালন্দা। আর পরিচিতি? এই গ্রাম বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষায় ‘বিকাশ’ কি হয়নি এখানে? সাদা চোখে দেখলে, হয়েছে। কিন্তু বিকাশ মানে তো ‘সবকা সাথ’ও! সেটা কি হয়েছে? ষাটোর্ধ্ব পার্বতী দেবী মাথা নাড়লেন। গ্রাম্য বিহারিতে যা বললেন তাতে দাঁড়ায়, ‘ঠিক বলেছেন... আসলে আমাদেরই কপাল খারাপ।’
তাল কেটে গেল নীতীশের পৈতৃক ভিটের সামনে শান বাঁধানো বটতলায়। জমে ওঠা আড্ডার তাল। পার্বতী দেবীর উদাসী কণ্ঠস্বর যেন একপাক বেড় দিয়ে এল বটগাছটাকে। পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলেন রাম কুমার—‘ছোড়িয়ে... ভগবান ভি কিসিকো সব দেকে খুশ নেহি কর সকতা। নীতীশজি তো আখির ইনসান হ্যায়!’ বোঝা গেল, পার্বতী দেবী আর রাম কুমারের সম্প্রদায় এক নয়। আপনি কোন সম্প্রদায়ের? ‘কুর্মি’... উত্তর দিলেন রাম কুমার।
নীতীশ কুমার নিজেও এই অনগ্রসর কুর্মি সম্প্রদায়েরই সন্তান। বিহারে বিশ বছরের মুখ্যমন্ত্রী। আর কল্যাণ বিগহার বেশিরভাগ মানুষই এই শ্রেণির। চোখে-মুখে গর্বের ছোঁয়া রাম কুমার, সুরেশ কুমারদের। নীতীশের বাড়ির উল্টোদিকেই ‘১৫ সাল বেমিসাল’ লেখা নীল রঙের বোর্ডটা ফ্যাকাশে পড়ে রয়েছে। বিহারের সর্বকালের বেশি সময়ের মুখ্যমন্ত্রী থাকার রেকর্ড গড়ার সময় বসেছিল ওই বোর্ড। এবার তা পালটানোর সময় এসেছে। কারণ, ‘ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নিজের রেকর্ড এবার নাকি নিজেই ভাঙবেন নীতীশ’... বলছিলেন সুরেশ।
কিন্তু পার্বতী দেবী?
তাঁরা হরিজন। মহা দলিত। বিহারের সবথেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি। ঘটনাচক্রে নীতীশের বাড়ির সামনের রাস্তার ঠিক উলটোদিকের গলি ধরে এগিয়ে গেলেই পড়বে ‘হরিজন টোলা’। মহা দলিতদের পাড়া। কল্যাণ বিগহায় ৫০ থেকে ৬০ ঘর হরিজন সম্প্রদায়ের বাস। জনসংখ্যা ২০০’র কিছু বেশি। কোনওমতে ইটের তৈরি একচালা ঝুপড়ি। কোনওটা আবার বিচালি ছাওয়া। দারিদ্র্যের চিহ্ন পাড়াজুড়ে। উন্নয়ন, আর প্রচারের মাঝে এ যেন এক অন্য কল্যাণ বিগহা।
নীতীশ জানেন? ‘হামরা মুন্না তো রাজা বন গয়া। ক্যায়সে বাতায়ে এ সব?’ বলছিলেন নীতীশেরই সমসাময়িক সারোগি মাঝি। মুখ্যমন্ত্রী বছরে তিনবার আসেন গ্রামে। বাবা, মা ও স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকীতে। ২০১০ সালে নীতীশের স্ত্রীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে গ্রামের সবার নিমন্ত্রণ ছিল। সেই নাকি নীতীশের সঙ্গে শেষ দেখা সারোগির—‘আমাদের জীবনের অন্ধকার দূর হবে না। নীতীশ কী করবে? জন্মই আমাদের অভিশাপ!’
হরিজন টোলার উলটোদিকেই নীতীশের ভিটের কেয়ারটেকার সীতারামের দোতলা বাড়ি। ওদিকে আঙুল উঁচিয়ে কিছুটা আক্ষেপের সুরে সারোগির প্রতিবেশী অনুজ মাঝি বলছিলেন, ‘২০২০ সালেই দু’বার প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা পেয়েছে সীতারাম। নীতীশ চাইলে আমাদেরও দিতে পারতেন। কিন্তু দেবেন না। ওরা দিতে দেবে না। সবই জন্মের দোষ!’
অথচ নীতীশের ‘কল্যাণে’ কল্যাণ বিগহার ভোল পালটেছে বহুদিন আগেই। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে মুখ্যমন্ত্রীর বাবা-মায়ের নামাঙ্কিত মেমোরিয়াল পার্ক। ৩০ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে সংযোগকারী চার লেনের রাস্তা, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, পাওয়ার স্টেশন, সরকারি হাসপাতাল। নালন্দা জেলার হরনৌত বিধানসভায় কল্যাণ বিগহা বহুদিন আগেই বিহারের অন্যতম মডেল গ্রাম। এখানে নীতীশ ঈশ্বরতুল্য। গ্রামের কুর্মি, ব্রাহ্মণ, অতি অনগ্রসর ‘কাহার’ বা ‘নাই’ শ্রেণি থেকে পাসোয়ানদের মতো মহা দলিত হরিজনরা এবারও জেডিইউ প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। কেন?