বাঙালির হাতে বিশ্বকাপ! ‘জীবন দেওয়ার শপথ নিয়ে নেমেছিলাম’, বললেন রিচা, ৪৫ রাত না ঘুমিয়ে কাটানোর যন্ত্রণা ভুললেন মন্ধানা
আনন্দবাজার | ০৩ নভেম্বর ২০২৫
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পারেননি। ঝুলন গোস্বামী পারেননি। রিচা ঘোষ পারলেন। শিলিগুড়ির মেয়ের হাত ধরে বাঙালি প্রথম বার ক্রিকেট বিশ্বকাপ হাতে ছুঁয়ে দেখল। রবিবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ফাইনালে রিচার ৩৪ রান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ম্যাচের পর রিচা জানালেন, জীবন বাজি রেখে নেমেছিলেন ফাইনালে। বিশ্বকাপ জিতে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
রিচা জানিয়েছেন, নিজেদের সেরাটা দেওয়ার পণ করেই নেমেছিলেন তাঁরা। তাঁর কথায়, “সকলে একটাই কথা বলেছিলাম, এটাই প্রতিযোগিতার শেষ দিন। নিজেদের মধ্যে যা আছে পুরোটা উজাড় করে দিতে হবে। নিজের শরীর, শক্তির শেষ বিন্দু সমর্পণ করতে হবে। একে অপরের জন্য খেলব আমরা। সব উজাড় করে দাও, এটাই ছিল আসল মন্ত্র।”
এত বড় মঞ্চে নিজের সেরাটা দেওয়াও কি চাপের নয়? রিচার স্পষ্ট উত্তর, “চাপ ছিল ঠিকই। মাঠে প্রচুর লোক এসেছিলেন। এই পরিবেশে আমরা খুব একটা খেলিনি। আমি নিজেকে বলেছিলাম, অনেক পরিশ্রম করেছি। এ বার নিজের উপর বিশ্বাস রাখার পালা। দলের সকলে বিশ্বাস করেছিল যে আমি ম্যাচে প্রভাব ফেলতে পারি। সেই আস্থা আমাকে খুব সাহায্য করেছে।”
রিচার সংযোজন, “বিশ্বকাপ জয় আমাদের কাছে স্বপ্নপূরণ। বহু দিন অপেক্ষা করেছি। স্বপ্ন অবশেষে সত্যি হল। আমরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কী রকম লাগছে সেটা বলতেই পারব না। সকলে আমাদের দেখছে। এটুকু বলতে পারি, এই অনুভূতি বাকি সব কিছুর চেয়ে আলাদা।”
নাদিন ডি ক্লার্কের ক্যাচ হরমনপ্রীত কৌর ধরার পরেই শুরু হয়েছিল আবেগের বিস্ফোরণ। হরমনপ্রীত হাত তুলে ডিপ কভারের দিকে দৌড়তে থাকেন। তাঁকে ঘিরে ফেলেন সতীর্থেরা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন সকলে। আকাশে প্রবল শব্দে ফাটছিল বাজি। সকলে তা দেখতে থাকেন। ইয়ান বিশপ তখন ধারাভাষ্য দিতে দিতে বলছিলেন, “এই জয় গোটা দেশকে চাঙ্গা করে দেবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে একটা প্রভাব ফেলে দিল এই জয়।”
দর্শকাসনে আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহের পাশে বসে আবেগ সামলাতে পারেননি রোহিত শর্মাও। তাঁরও চোখ ভিজে আসে। মাঠে দেখা যায়, স্মৃতি এগিয়ে গিয়ে হরমনকে জড়িয়ে ধরেছেন। একের অপরকে ছাড়ছিলেনই না। এর পর স্পিনত্রয়ী রাধা যাদব, শ্রী চরণী এবং দীপ্তি শর্মা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। যে বলটি ক্যাচ ধরেছেন সেটি কাছছাড়া করছিলেন না হরমনপ্রীত। কিছু ক্ষণ পরেই তাঁর চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসে জল। পিঠ চাপড়ে সামাল দিতে থাকেন রিচা। সাপোর্ট স্টাফের এক সদস্য কয়েকটি পতাকা নিয়ে এসে ক্রিকেটারদের হাতে তুলে দেন। কোচ অমল মুজুমদার, স্নেহ রানাদের দেখা যায় সেই পতাকা জোরে জোরে নাড়াতে। শেফালি বর্মা এবং রেণুকা সিংহ একটি স্টাম্প তুলে নেন স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে।
উল্টো দিকে তখন একরাশ বিষণ্ণতা। দক্ষিণ আফ্রিকার ডাগআউটে তখন শোকের আবহ। ফাইনালে শতরান করেও ম্যাচ শেষ করে আসতে না পারায় লরা উলভার্টের চোখে তখন শূন্যতা। ভারতীয় ক্রিকেটারেরা গিয়ে সান্ত্বনা দিলেন মারিজ়ান কাপকে, যাঁর এটিই বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ ছিল।
আবেগ সামলে কোনও মতে সঞ্চালকের সামনে যখন স্মৃতি পৌঁছলেন, তখনও তাঁর চোখে জল। বললেন, “যত বার বিশ্বকাপ খেলেছি তত বার হৃদয় ভেঙেছে। তবে বরাবরই জানতাম আমাদের কাঁধে একটা বড় দায়িত্ব আছে। শুধু জেতা নয়, মহিলাদের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব। সত্যি বলতে, গত কয়েক মাসে যে সমর্থন আমরা পেয়েছি তার সঙ্গে কিছুর তুলনা হয়। আজ বিশ্বকাপটা হাতে তুলতে পেরে আমি গত ৪৫টা না ঘুমনো রাত ভুলে যেতে পারি।”
স্মৃতি আরও বলেন, “আগের বিশ্বকাপ আমাদের সকলের কাছে একটা কঠিন শিক্ষা ছিল। তার পর আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, প্রতিটা বিভাগে আরও শক্তিশালী এবং উন্নতি করা। আরও ফিট থাকা। সত্যি বলতে, এই দলের আমরা যে ভাবে ঐক্যবদ্ধ থেকেছি সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। সব সময়ে একে অপরকে সমর্থন করেছি। খারাপ দিন, ভাল দিন দুটোই দেখেছি। একে অপরের সাফল্য উপভোগ করেছি। এ বার যে পরিবেশে প্রতিযোগিতা জুড়ে ছিল সেটাই ভাল খেলতে আমাদের সাহায্য করেছে।”
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চোট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন প্রতিকা রাওয়াল। ফাইনালে তিনিও হাজির হয়েছিলেন হুইলচেয়ারে চড়ে। ট্রফি তোলার সময়েও তাঁকেও মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়। প্রতিকা বলেন, “এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার কাঁধের পতাকাই অনেক কথা বলে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে দলের সঙ্গে থাকাটাই একটা বিশেষ অনুভূতি। চোট তো খেলারই অংশ। এখনও যে দলের সঙ্গে রয়েছি এটাই বড় ব্যাপার।”
বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব অনেকটাই প্রাপ্য কোচ অমলের। গত দু’বছরে মহিলা দলকে অনেকটাই বদলে দিয়েছেন তিনি। দেশের হয়ে একটিও ম্যাচ খেলেননি। অথচ কোচ হিসাবে বিশ্বকাপ জিতে ফেললেন। তাঁর কথায়, “আমি নির্বাক। অত্যন্ত গর্বিত। মেয়েরা এই মুহূর্ত উপভোগ করার যোগ্য দাবিদার। কঠোর পরিশ্রম এবং আত্মবিশ্বাসে ভর করে ওরা সকল ভারতবাসীকে গর্বিত করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতের মহিলাদের ক্রিকেটে এটা যুগান্তকারী মুহূর্ত। আগামী কয়েকটা প্রজন্ম এর সুফল পাবে।”
উলভার্টের ক্যাচ তাঁর হাত থেকে আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল। তৃতীয় বারের প্রচেষ্টায় ক্যাচ নিয়েছিলেন। সেই ক্যাচ প্রসঙ্গে আমনজ্যোৎ কৌর বলেছেন, “আমরা সকলেই জানতাম ওই উইকেট কতটা গুরুত্বপূর্ণ। খুশি যয়ে ক্যাচটা নিতে পেরেছি।”