অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বেরা
বয়স সাকুল্যে ন’দিন! খিঁচুনি তেমন কমেনি। হৃৎপিণ্ডটা বড্ড দ্রুত উঠছে-নামছে। একরত্তিটা নেতিয়েই রয়েছে। ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের চিকিৎসকরাও উদ্বিগ্ন। হাসপাতালের এমএসভিপি অনুরূপ পাখিরা বলছেন, ‘আমাদের স্পেশালিস্টরা ওই শিশুটিকে সুস্থ্ করতে সব চেষ্টাই চালাচ্ছেন। প্রয়োজনে আরও বড় হাসপাতালে রেফার করব।’
পুলিশ সূত্রে খবর, একরত্তির এমন অবস্থার কারণ তার নিজের ঠাকুমা, মালা মল্লিক। মেয়ে হয়ে জন্মানোর ‘অপরাধে’ শনিবার সকালে নাতনির মুখে চামচ দিয়ে কীটনাশক খাইয়ে দিতে হাত কাঁপেনি তাঁর। খুদেকে নিয়ে যখন যমে-মানুষে টানাটানি চলছে। ওই শিশুকন্যার দাদুর অভিযোগের ভিত্তিতে মালাকে রবিবার গ্রেপ্তার করেছে বেলিয়াবেড়া থানার পুলিশ। ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) সৈয়দ এম এম হাসান ‘এই সময়’কে বলেছেন, ‘আদালত অভিযুক্তকে চার দিনের পুলিশ হেফাজত দিয়েছে। মালা আমাদের কাছে কীটনাশক খাওয়ানোর কথা কবুল করেছেন’
শিশুকন্যার মায়ের অভিযোগ, শুধু শাশুড়িই নয়, তাঁর স্বামীও এই কাজে মদত দিয়েছেন। কারণ তিনি-ও চাইতেন— ছেলে হোক! স্ত্রীর দাবি, স্বামীর সঙ্গে ফোনে গল্প হলেও পুরো গল্প জুড়েই থাকত রাজপুত্রের রূপকথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতেন শিশুপুত্রদেরই প্রতীকী ছবি। মানতও করেছিলেন যাতে ছেলেই হয়! মায়ের কথায়, ‘মেয়ে হয়েছে শুনে ও কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। ২৫ অক্টোবর মেয়ে জন্মেছে। কিন্তু বাবা হয়ে মেয়ের মুখটা পর্যন্ত দেখেনি।’ পুলিশ সূত্রে খবর, রবিবার চেন্নাই থেকে ফিরেছেন মেয়েটির স্বামী। তবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে পুলিশ কিছু জানায়নি।
যে প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী ভাবে উঠছে— কেন এখনও কন্যাসন্তানকে নিয়ে এত ছুঁৎমার্গ? এখনও কি ভাবা হচ্ছে, মেয়ে মানে তার বিয়ে আর পণ-ই আসল? তাই তার উপরে খরচ আদতে ‘অপচয়?’ নাকি ‘জেন্ডার সেনসিটাইজ়েশন’-এ কোথাও পুলিশ-প্রশাসনের তরফেও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে?
পুলিশ জানিয়েছে, মেয়েটির মায়ের বয়স-ই ১৭ বছর! তার বরের ২২। অর্থাৎ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন ও পকসো-র একাধিক ধারায় মামলা করার সুযোগও রয়েছে। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘ওরা পালিয়ে বিয়ে করে। পরে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হলে ফিরে আসে। তাই এই মামলাও করাই যায়। কিন্তু এখন ওই বাচ্চা আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি।’ যদিও পুলিশ সূত্রে খবর, এখনও এই দু’টি আইনের কোনও ধারায় কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি।
তবে রাজ্যেরই মহিলা, শিশু ও সমাজকল্যাণ দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘মামলা করেই বা কী হবে! … সুপ্রিম কোর্টই তো আজকাল পালিয়ে বিয়ে ও সেই সংক্রান্ত পকসো কেসে শাস্তি দিচ্ছে না। কন্যাশ্রী-রূপশ্রী রয়েছে, তার পরেও যদি মেয়েরা-অভিভাবকরা না বোঝেন, মেয়ে পালিয়ে গিয়ে ১৮-র আগে বিয়ে করে ও সন্তানের জন্ম দেন সেখানে তা কী ভাবে প্রতিরোধ করা যাবে?’ আর এই ঘটনায় তাঁর বক্তব্য, ‘বাচ্চাকে বড় করার সামর্থ্য না থাকলে তো সরকারের নানা প্রকল্পে সহায়তা মেলে। এমনকী স্বেচ্ছায় দত্তকেও দেওয়া যায়, কিন্তু এত নৃশংস মনোভাব কেন?’
সে কথাই প্রমাণ করছে ঝাড়গ্রাম পুলিশের কিছু অভিজ্ঞতাও। পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘স্বয়ংসিদ্ধার ব্যানারে না হলেও আমাদের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে নিয়মিত সাইবার সচেতনতা শিবির হয়। সেখানে সব সময়ে বাল্যবিবাহ, শিশু-সুরক্ষা নিয়ে আমরা বলি।’ তিনি জানান, মানুষের নানা সমস্যা শুনতে ও বোঝাতে তাঁদের নিয়মিত ‘সহায়’ ক্যাম্পও হয়। সেখানে নিয়ম করে এগুলো বোঝানো হয়। তার পরেও খুব ইতিবাচক ফল মিলছে না।’
তা হলে? এক পুলিশকর্তা বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীজি তো মেয়ে জন্মালে মেহগনি গাছ লাগাতে বলেছেন। কারণ ১৮ বছর বা তার পরে বিয়ে হলে সে খরচ ওই গাছ বিক্রি করলেই উঠে আসবে! কই তাকে উচ্চশিক্ষিত করতে হবে, আত্মনির্ভর হতে হবে … সে কথা তো বলেননি!’ তাঁর ব্যাখ্যা, সমস্যা তো অধিকাংশের মানসিকতায়। ফলে এখনও কতটা পথ হাঁটলে আমাদের সমাজ কন্যাসন্তানের সমান গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে, সে অঙ্ক বোধহয় শুরুই হয়নি!