বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: অক্টোবরে হাতির হামলায় অন্তত ১২ জনের মৃত্যু উত্তরে। গত মার্চ মাস থেকে বুনো হাতি ও মানুষের সংঘাত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ জনের। মাঠে ধান পাকায় নভেম্বরে সংঘাত বাড়ার শঙ্কা। বিশেষত বানভাসি এলাকায়। সেখানে খাবার না পেয়ে বুনোরা মারমুখী হতে পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বনদপ্তরের বাড়তি নজরদারি শুরু। বসানো হচ্ছে সৌর সিসি ক্যামেরা। এলাকায় হাতি দেখা মাত্র বাজবে সাইরেন। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।
বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, এবার মার্চ মাস থেকে লোকালয়ে বুনো হাতির হানা চলছে। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চারমাসে আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলার জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় হাতি ও মানুষের সংঘাতে অন্তত ২৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। বিশেষ করে বৈকুন্ঠপুর ও জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা বেশি ঘটেছে। সংঘর্ষ বেশি হয়েছে মে মাসে। ১৪ মে হাতির হানায় জলপাইগুড়ির গজোলডোবা তিস্তা ক্যানেল সংলগ্ন ভালোবাসা মোড়ের কাছে ঠকঠকি মোড় এলাকায় এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২২ মে বৈকুন্ঠপুর বনবিভাগের জঙ্গল থেকে হাতি লোকালয়ে বেরিয়ে দু’জনকে আছড়ে মারে। ২৪ মে রাতে নকশালবাড়ি সংলগ্ন কলাবাড়ি মোড়ে হাতির হামলায় মৃত্যু হয় স্থানীয় এক বাসিন্দার। ৩১ মে রাতে ফালাকাটা ব্লকের কুঞ্জনগরে হাতির হানায় একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। বেঘোরে প্রাণ হারান বৃদ্ধা মা, ছেলে ও এক সদ্যোজাত শিশুকন্যা৷ তবে ৪ অক্টোবর রাতে হড়পা বানের পর পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। বন্যার জলে ভেসে আসা পলি ও ডলোমাইটে তলিয়েছে জঙ্গলের তৃণভূমি। দূষিত হয়েছে জঙ্গলে নদীনালার জল। বন দপ্তরের কর্তাদের মতে, ওই কারণে হাতি, গন্ডার, বাইসন নিজেদের বসতি এলাকায় থাকতে না-পেরে লোকালয়মুখী হতে শুরু করে।
নেপাল সীমান্তের মেচি নদী থেকে অসম সীমানা সংলগ্ন সংকোশ নদী পর্যন্ত একই পরিস্থিতি। বৃহস্পতিবার ৭৮টি হাতির একটি দল শিলিগুড়ি মহকুমার টুকরিয়াঝার জঙ্গল থেকে নকশালবাড়ি চা বাগানে ঢুকে পড়ে। বুনো হাতির মিছিল দেখে আতঙ্কিত চা বাগানের শ্রমিক মহল্লার বাসিন্দারা। কার্শিয়াং বন বিভাগের কর্মীরা অনেক কসরতের পর দলটিকে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। কিন্তু সব সময় সেটা সম্ভব হচ্ছে তা নয়। হাতি-মানুষের সংঘাতে প্রাণ যাচ্ছে। শুধু অক্টোবর মাসেই উত্তরের বিভিন্ন প্রান্তে হাতির হামলায় অন্তত ৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। জলদাপাড়া সংলগ্ন আলিপুরদুয়ার এবং গরুমারা সংলগ্ন জলপাইগুড়ি জেলায় বেশি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। অক্টোবরের প্রথম চারদিনে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
হড়পা বানের পর ৯ অক্টোবর রাজগঞ্জ ব্লকের মান্তাদাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের সরস্বতীপুর চা বাগানে বুনো হাতির হামলায় মৃত্যু হয় এক চা শ্রমিকের। ২২ অক্টোবর মাদারিহাট এলাকায় একটি দাঁতাল হাতি এক শিশু ও মা-সহ তিনজনকে পিষে মারে। ৩১ অক্টোবর মাদারিহাট এলাকার মেঘনাদ সাহা নগরে এক মহিলাকে আছড়ে মারে হাতি। এরপর মাদারিহাটের মধ্য ছেকামারি এলাকায় এক প্রবীণকে মারে দলছুট হাতি। নাগরাকাটার নিউখুনিয়া বস্তিতে হাতির হামলায় মৃত্যু হয় এক ব্যক্তির।
জলদাপাড়ার ডিএফও প্রবীণ কাসোয়ান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ২৯টি দল পাহারা দিচ্ছে, মাইকিং চলছে। নজরদারি বাড়াতে ৩০টি সৌর সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এছাড়াও কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। প্রায় একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তরাই এলাকায়। বাগডোগরার রেঞ্জার সৌম্যব্রত সাধু জানান, এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বনদপ্তরের তরফে জঙ্গল লাগোয়া বিভিন্ন বনবস্তিতে সতর্কতার প্রচার শুরু হয়েছে। পর্যটকদের জঙ্গল সাফারির সময় জিপসিচালক ও গাইডদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। হাতি দেখলে সেখান থেকে দ্রুত সরে যাওয়া এবং সেই রাস্তা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।