• সন্তোষ দত্ত ‘কম পড়িয়াছে’
    বর্তমান | ০৫ নভেম্বর ২০২৫
  • বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিমদের শতবর্ষ উদযাপন। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁদের ছবির রেট্রোস্পেক্টিভ দেখা যাবে। উৎসব শুরুর আগে ফিরে দেখা কিংবদন্তিদের। সন্তোষ দত্তকে নিয়ে লিখছেন সুদীপ্ত রায়চৌধুরী।

    বাড়ি ভর্তি নাটকের বই। বেশিরভাগই গিরিশ ঘোষের। পড়াশোনার ফাঁকে সেই সব বই উল্টেপাল্টে দেখত বছর ছয়েকের ছেলেটা। আর বাবা কখন অফিস থেকে ফিরবে, তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। কারণ প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে নাটক পাঠ করতে বসতেন পূর্ণচন্দ্র দত্ত। বাবার সঙ্গী হত ছেলে, সন্তোষ দত্ত। গিরিশ ঘোষের কোনও নাটকের দু’টি চরিত্র বেছে নিয়ে তাঁরা পাঠ করতেন। অভিনয় করতেন। নাটক হোক বা অভিনয়, সন্তোষ দত্তের হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। নাট্যরসিক, অভিনেতা বাবার কাছে।

    কলেজে পড়ার সময় ছেলেকে ডেকে বাবা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘ভালো অভিনয় করতে হলে মেয়েদের চরিত্র করবি।’ বাবার কথামতো বেশ কিছু নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মাটির বাড়ি’ নাটকে তন্দ্রার চরিত্রে অভিনয় করে সোনার মেডেল পান সন্তোষ দত্ত। তাঁর অভিনয় জীবনের প্রথম পুরস্কার। এরপর আরও কয়েকটি নাটকে মেয়েদের চরিত্র করার পর সেই বাবাই তাঁকে বলেন, ‘তোমার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন ঘটেছে এখন থেকে আর কোনও নারী চরিত্রে অভিনয় করো না।’ তারপর আর কোনওদিন নারী চরিত্রে অভিনয় করেননি। অভিনয়ের শিক্ষাগুরুর বারণ ছিল যে।

    সন্তোষ দত্তকে আপামর বাঙালি চিনল কবে থেকে? জনপ্রিয়তার নিরিখে উত্তর একটাই - ‘সোনার কেল্লা’। তার অনেক আগেই আমরা শুন্ডি ও হাল্লার রাজাকে দেখে ফেলেছি। দিব্যি ভালোও লেগেছে। কিন্তু লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু চরিত্রে আম বাঙালির প্রাণের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে প্রথম আবির্ভাব হয় জটায়ুর। নাটক দেখতে গিয়ে সন্তোষ দত্তকে খুঁজে পান সত্যজিৎ রায়। সন্তোষবাবু তখন ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যস্ত আইনজীবী হিসেবে পসার জমে উঠেছে। তার সঙ্গেই চলছে অভিনয়। অভিনেতা-গায়ক সবিতাব্রত দত্তের দলে নিয়মিত অভিনয় করতেন তিনি। মা সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে তাঁদের নাটক ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ দেখতে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘ভবদুলাল’-এর চরিত্রে ছিলেন সন্তোষ। এর পরেই ‘পরশ পাথর’ ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে সন্তোষ দত্তকে নেন তিনি। সেই অভিনয় দেখেই সত্যজিৎ রায় ঠিক করে ফেলেন, এঁকে পরে অবশ্যই ব্যবহার করা যায়। তারপর একে একে ‘তিনকন্যা’ ছবির ‘সমাপ্তি’, ‘মহাপুরুষ’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জন অরণ্য’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ও ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। এত কিছুর পরেও জটায়ু চরিত্রে তিনি নিজেকে এমনভাবে খোদাই করে দিতে পেরেছিলেন যে, বহু তুখোড় অভিনেতা জটায়ু হয়েও সন্তোষ দত্তকে ছুঁতে পারেননি। আসলে জটায়ুর ছায়ায় আমরা অনেকেই ভুলতে বসেছি ‘জন অরণ্য’-এর হীরালাল, ‘সমাপ্তি’ ও ‘হারমোনিয়াম’-এর কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, ‘গোপাল ভাঁড়’-এর গোপাল, ‘চারমূর্তি’র মেসোমশাইকে। ‘ওগো বধু সুন্দরী’ সিনেমায় অবলাকান্ত চরিত্রে উত্তমকুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনি। শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে সন্তোষ দত্তকে কাল্টিভেট করা হবে আসন্ন ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ‘সন্তোষ দত্ত স্মরণে’ নামক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে। জনপ্রিয়তার নিরিখে বাংলার বহু অভিনেতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া সন্তোষ দত্ত কখনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বা রাজ্যস্তরের সম্মান পাননি। কেন যে পাননি...!

    জটায়ু থাকলে নির্ঘাৎ বলতেন, ‘হাইইলি সাসপিশাস…!’
  • Link to this news (বর্তমান)