সৈকত মাইতি, তমলুক: প্রতিবেশীর বাড়িতে খেলতে গিয়ে পায়ের নূপুর চুরির অপবাদ! আর তাতেই অপমানে অভিমানে চুলের রং করা রাসায়নিক খেয়ে আত্মঘাতী হলেন ভগবানপুর এর এক পঞ্চম শ্রেণির স্কুলছাত্রী। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর থানার গুড়গ্রাম এলাকার মর্মান্তিক এই ঘটনাকে ঘিরে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়ায়। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, পঞ্চম শ্রেণির স্কুলছাত্রী সঙ্গীতা বেরা। বাবা উত্তম বেরার একটি ছোটখাটো খাবারের দোকান রয়েছে। তাই ছোট্ট তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসার সামাল দিতে বাড়িতে পরচুলার কাজ করতেন মা মীতা বেরা। এমন অবস্থায় মঙ্গলবার বিকেলে পাশের বাড়ির বছর তিনেকের শিশুকন্যার সঙ্গে খেলতে যায় সঙ্গীতা।
এদিকে, ভগবানপুর থানার গুড়গ্রাম এলাকায় মনসা পুজো উপলক্ষে মেলার আয়োজন হয়েছিল। সেখানেই একসঙ্গে মেলায় বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল ওদের। এমন অবস্থায় মেলা অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সাজুগুজু করতে গিয়ে পাশের বাড়ির ওই শিশুকন্যাটির একটি পায়ের নূপুর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আর তাতেই নূপুর চুরির জন্য দায়ী করে বকাঝকা শুরু করেন প্রতিবেশী ওই পরিবার। ফলে একরকম প্রায় নিরুপায় হয়ে চুরির অপবাদ মাথায় চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে আসে একরত্তির মেয়েটি। এতেই অপমানিত বোধ করে নিজের মেয়েকে শাসন করার পাশাপাশি দুই একটি চড় কষিয়ে দেন মা। ফলে একদিকে সর্বসমক্ষে প্রতিবেশীদের অপবাদ অন্যদিকে আবার মায়ের বকুনি। আর এতেই অপমানে অভিমানে মেলা থেকে ফিরেই রাতে বাড়িতে ঢুকে চুলের রং করা রাসায়নিক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ছোট্ট মেয়েটি।
আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাতেই তাকে তাম্রলিপ্ত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতেই তার মৃত্যু হয়। আর সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। বুধবার বিকেলে মেডিকেল কলেজের মর্গে মৃতদেহটি ময়নাতদন্তের পর পরিবারের হাতে তুলে দেয় পুলিশ। একরত্তির দেহ বুকে নিয়ে কোন রকমে চোখের জল সামাল দিয়ে কাকা সোনা বেরা বলেন, ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটির টানে আকৃষ্ট হয়ে প্রায় সময় পাশের বাড়িতে খেলতে ছুটে যেত ভাইঝি। কিন্তু তার মধ্যেই যে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে সামান্য কয়েকটা পয়সার নূপুর চুরির অপবাদ এমন ঘটনা ঘটলো সেটা খুবই দুঃখজনক। স্থানীয় এক যুবক মানস কুমার আদক বলেন, “চোখের সামনে যে এমন একটা ঘটনার সাক্ষী হতে হবে সেটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নূপুর চুরির অপবাদ কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না ফুলের মত নিষ্পাপ ওই মেয়েটি। আর তাতেই বাড়িতে রাখা চুলের রং করা রাসায়নিক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে সে।” ঘনঘন মূর্ছা যাচ্ছেন মা। মেয়ের মৃত্যুশোকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন বাবা উত্তম বেরা।
এ বিষয়ে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অলোক পাত্র বলেন, “বর্তমানে ক্রমশই পরিবার ছোট হচ্ছে। পড়াশোনার চাপে খেলাধুলা, বিনোদনের পরিসর কমে যাওয়ায় সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে মেলামেশাও কম। খুব স্বাভাবিক কারণেই এই বয়সের ছেলেমেয়েরা আরও বেশি করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। তাই ওদের আরও বেশি করে ভালোবাসা প্রয়োজন। কারণ শুধুমাত্র পড়াশুনা নির্ভর জীবন হওয়ায় মূল্যবোধের জায়গাটাও ওরা হারিয়ে ফেলছে। ফলে অল্প কিছুতেই বাবা-মায়ের বকুনিতেই যেন ওদের কাছে গোটা পৃথিবীটাই শূন্য হয়ে যাচ্ছে। ওরা আর নিজেদের মনের কষ্ট কারো কাছে শেয়ার করে নিতে পারছে না। তাই আমাদের উচিত এই সকল শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি আরো বেশি করে যত্ন সহকারে পরিবেশ পশুপাখিদের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে খেলার মাঠে যাওয়ার অভ্যাসে পরিণত করা। অন্ততপক্ষে কোনরকমের মানসিক আঘাত পেলে তারা যাতে মলম লাগানোর জায়গা খুঁজে পায় সেই চেষ্টা করা।”