এই পথে হাঁটতেন হিউয়েন সাং! নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়ালে এই কথাটি প্রথমেই মনে আসতে বাধ্য। বিশ্বের প্রথম সঠিক অর্থের বিশ্ববিদ্যালয়। প্রবেশাধিকার পেতে হলে বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে জটিল, খুঁটিনাটি প্রশ্নের মুখে পড়তে হত। দশ জনের মধ্যে আট জনই সেই পরীক্ষায় ব্যর্থ হত। রাজপরিবারের সন্তান হলেও ছাড় মিলত না। মেধাই ছিল একমাত্র মাপকাঠি।
ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ তকমাপ্রাপ্ত সেই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রের ধ্বংসস্তূপে রোজ দেশবিদেশের হাজারো মানুষের ভিড়। সেই পথে কয়েক পা এগোলেই আদর্শ মধ্য বিদ্যালয়, নালন্দা। ছিয়াশি বছরের পুরনো সরকারি স্কুল। কমলা রঙের দোতলা ভবন। কয়েকটি শিশু খেলে বেড়াচ্ছে। শিক্ষিকারা স্কুলের করিডরে চেয়ার পেতে গল্পগুজব করছেন। নালন্দার ধ্বংসস্তূপ থেকে কয়েক পা দূরের এই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা হাতে গোনা। স্কুলে ভর্তি হলেও অনেকে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। স্কুলবাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে।
বিহারের নালন্দা জেলার সূরজপুর নগর পঞ্চায়েতের এই স্কুল কোনও ব্যতিক্রম নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের স্কুল শিক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিহারে এমন ১১৭টি স্কুল আছে, যেখানে পড়ুয়া নেই। অথচ ৫৪৪ জন শিক্ষক এই সব স্কুলে নিযুক্ত। উল্টো দিকে, ২৬৩৭টি এমন স্কুল রয়েছে, যেখানে মাত্র এক জন করে শিক্ষক। অথচ এই সব স্কুলে ২ লক্ষ ৯১ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছে। বিহারে মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার হার গোটা দেশে সব থেকে বেশি। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি পড়ুয়া স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়। নবম-দশম শ্রেণিতেও ২৫ শতাংশের মতো পড়াশোনা ছেড়ে দেয়।
বিহারে গত ২০ বছর ধরে এনডিএ সরকার চলছে। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এই সরকারের প্রধান শরিক। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এনডিএ ভোটের ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। তাতে শিক্ষা নিয়ে কী বলা রয়েছে, দেখা দরকার। কারণ বিহারের পরেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। সেই ভোটে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে ‘টিএমসি হঠাও, বাংলাকে বাঁচাও’ স্লোগান তুলে অভিযোগ করেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা ধ্বংস করে দিয়েছে। তৃণমূলের দুর্নীতির ফলে হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। ফলে স্কুল পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের মুখে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলকে দুষেছেন ঠিকই, তবে বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কী নীতি নেবে, তা নিয়ে রাজ্যের বিজেপি নেতাদের মুখে বিশেষ উচ্চবাচ্য শোনা যায় না।
বিহারে এনডিএ-র ৬৯ পৃষ্ঠার নির্বাচনী ইস্তাহারে শিক্ষা নিয়ে তিনটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ। তাতে কেজি থেকে পিজি— বা প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত নিখরচায় উচ্চমানের শিক্ষার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।বলা হয়েছে, সমস্ত গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য নিখরচায় শিক্ষা, মিড-ডে মিলে পুষ্টিকর খাবারের বন্দোবস্ত হবে। স্কুলে তৈরি হবে আধুনিক‘স্কিল ল্যাব’। ‘এডুকেশন সিটি’ তৈরি করে বিশ্ব মানের শিক্ষা পরিকাঠামো তৈরির কথা রয়েছে ইস্তাহারে। জেলার প্রধান স্কুলগুলির ভোলবদলে ৫ হাজার কোটি টাকা খরচের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিহারকে দেশের ‘এআই হাব’ করে তুলতে উৎকর্ষ কেন্দ্র তৈরির কথাও রয়েছে। এইটুকুই।
বিহার শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের মধ্যে সব থেকে পিছনের সারিতে। অথচ বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কোনও তর্কবিতর্ক নেই। কর্মসংস্থানের অভাব, কারখানা বা শিল্পের অভাব, চাকরির খোঁজে বিহারের মানুষকে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যেতে বাধ্য হওয়ার মতো সমস্যা এ বারের ভোটে উঠে এসেছে। কিন্তু রুটিরুজির জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন, সেই শিক্ষা নিয়ে ভোটের ময়দানে কোনও আলোচনা নেই। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ীই বিহারের ৭৮,১২০টি স্কুলের মধ্যে ১৬,৫২৯টি স্কুলে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। যে বিহারে একদা নালন্দার মতো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল, সেই বিহারে মাত্র ২২.৬৭ শতাংশ মানুষ কেবল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। রাজ্য সরকারেরই আর্থ-সামাজিক জাতগণনার রিপোর্ট। রাজ্যের জনসংখ্যার মাত্র ১৪.৭১ শতাংশ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। স্নাতক হয়েছেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ। বিহারের এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি মানুষ কখনও স্কুল বা কলেজে যাননি।
এতে কোনও ভুল নেই যে, পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থায় অন্ধকার নেমে এসেছে। ছাত্রছাত্রীরা যাঁর কাছে পড়তে যাচ্ছে, সেই শিক্ষক বা শিক্ষিকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন কি না, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়ে থাকলে কী ভাবে পড়শোনা হবে? শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়াবেন না কি রাস্তায় বসে আন্দোলন করবেন? শিক্ষকতার চাকরির পরীক্ষার্থীদের যদি পুলিশের লাঠি খেতে হয়, তা হলে শুধু তাঁদের সম্মান নয়, গোটা সমাজের সম্মান ধুলোয় মেশে।
এ বার দেখা যাক, গত কুড়ি বছর ধরে বিহারের ক্ষমতায় থাকা এনডিএ সরকার কী কাজ করেছে। নীতীশ কুমারের সরকার রাজ্যে লক্ষ লক্ষ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে বলে দাবি করছে। কিন্তু গত চার মাসে পটনায় শিক্ষকতার পরীক্ষার্থীদের দু’বার পুলিশের লাঠির মুখে পড়তে হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিহারের পাবলিক সার্ভিস কমিশন শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে শিক্ষকতার যোগ্যতা মান নির্ণয়ের জন্য যে ‘সেকেন্ডারি টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট’ হওয়ার কথা, তা ২০২৩ থেকে হয়নি। ফলে নতুন চাকরিপ্রার্থীরা শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার জন্য আবেদনই করতে পারছেন না। শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও ভূরি ভূরি প্রশ্ন। প্রথমে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হবে বলেও বিহারের এনডিএ সরকার শেষ পর্যন্ত ২০ হাজারের মতো শূন্যপদের তালিকা বার করেছে। এর আগে যত শূন্যপদের জন্য নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছিল, তার থেকে অনেক কম সংখ্যক চাকরিপ্রার্থীর মেধাতালিকা তৈরি হয়েছিল বলে অভিযোগ।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় অনাচারের দিকে আঙুল তুলে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়তে উদ্গ্রীব বিজেপি তা হলে রাজ্যের স্কুলশিক্ষার জন্য কোন পথে এগোবে? অবশ্যই, রাজ্যের বিজেপি নেতাদের মুখে এ সব নিয়ে বিশেষ কথাবার্তা শোনা যায়নি, যাবে না। তবে ধরে নেওয়া যায়, সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় এলে নরেন্দ্র মোদী সরকারের জাতীয় শিক্ষা নীতি নিয়ে এগোতে চাইবে। স্কুলশিক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পিএম-শ্রী বা ‘প্রধানমন্ত্রী স্কুলস ফর রাইজ়িং ইন্ডিয়া’ প্রকল্প রূপায়ণ করতে চাইবে। তিন বছর আগে ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে এই প্রকল্প চালু হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল, স্কুলগুলির মানোন্নয়ন। মোদী সরকারের এই অর্থ জোগানের শর্ত ছিল, স্কুলের নামের আগে ‘পিএম-শ্রী’ লেখা।
স্বাভাবিক ভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যের স্কুলে প্রধানমন্ত্রীর নাম লেখার শর্ত মেনে নেয়নি। পাল্টা চাপে কেন্দ্রীয় সরকারও সর্ব শিক্ষা অভিযান খাতে রাজ্যের টাকা আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী স্কুলের নামফলকেও নিজের ‘ব্র্যান্ডিং’ চান। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যের শিক্ষা খাতে অর্থের অভাব হলেও রাজনৈতিক কারণে তাতে বাধা দেন।
হিউয়েন সাং যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন, তার খরচ রাজারাই চালাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সংস্থানের জন্য নালন্দার ২০০টি গ্রামের রাজস্ব নির্দিষ্ট করা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার ও নিজস্বতায় রাজারা হস্তক্ষেপ করতেন না। হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্ত রাজারা বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একশো বছর ধরে তার সম্প্রসারণে সাহায্য করেছিলেন। অথচ মেধার মাপকাঠিতে উতরোতে না পারলে রাজপরিবারের সন্তানকেও ফিরিয়ে দেওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার মেনে নিয়েছিলেন।
কারণ একটাই। সেই সময়ে শিক্ষার ব্যাপারে রাজনীতি প্রাধান্য পেত না। রাজনীতি বা রাজার নীতিতে শিক্ষা প্রাধান্য পেত।