আমাদের দেশে তথ্যের অধিকার আইন চালু হওয়ার দু’দশক পার হল অক্টোবরে। দু’দশকে এই আইন কতটা কার্যকর হল, আর কতটা গুরুত্ব হারাল? ভারতে আইন প্রণয়নের ইতিহাসে এই তথ্যের অধিকার আইন বেশ বিশিষ্ট, কারণ এর পিছনে ছিল মেহনতি মানুষের দাবি। রাজস্থানের প্রত্যন্ত এলাকার শ্রমিক, কৃষকরা সরকারের থেকে তাঁদের মজুরি ঠিকমতো পাচ্ছেন কি না, তা সকলকে জানানোর দাবি তোলেন ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি। সেই দাবিকে জন আন্দোলনে পরিণত করতে এগিয়ে আসেন সমাজকর্মী অরুণা রায় এবং নিখিল দে ‘মজদুর কিসান শক্তি সংগঠন’-এর মাধ্যমে। ফলে শুধু নিজেদের মজুরির টাকা নয়, তাঁদের এলাকার উন্নয়নের কাজের হিসাব জানতে চাওয়া ও পাওয়া যে তাঁদের অধিকার, দরিদ্র মানুষেরা সেই দাবি তোলেন।
২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস দল তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে বলে যে তারা ক্ষমতায় এলে তথ্যের অধিকার আইন আনবে। সেই মতো ২০০৫ সালের ১৫ জুন সংসদে এই আইন পাশ হয়; ওই বছর ১২ অক্টোবর আইনটি চালু হয়। বিভিন্ন আদালত এর আগেই নানা সময়ে সংবিধানের ব্যাখ্যা করে বলেছিল যে, তথ্য জানাটা নাগরিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে এই আইন আসায় তথ্য জানার অধিকার আলাদা করে স্বীকৃত হল, তার পদ্ধতি ও পরিকাঠামো নির্দিষ্ট হল।
এই আইনের উদ্দেশ্য প্রশাসনে স্বচ্ছতা আর দায়বদ্ধতা আনা। ফলে এই আইনের জন্য দুর্নীতি কমার কথা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আইনসভায় প্রশ্ন করে যা জানতে পারেন, এক জন সাধারণ নাগরিকও এই আইনের ফলে তা জানতে পারবেন সরকারের থেকে। এই আইনের প্রয়োগের জন্য আদালতে যেতে হয় না। যে কোনও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ— যেমন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, এবং যে সব সংস্থা প্রধানত সরকারি অর্থে চলে, এই আইনের অধীনে নাগরিকের কাছ থেকে প্রশ্ন পেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তর দিতে বাধ্য। না দিলে আইন-নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এবং তথ্য কমিশনে আবেদন করা যায়। প্রশ্ন করার কারণও উল্লেখ করতে হয় না প্রশ্নকর্তাকে। ‘তথ্য’-এর সংজ্ঞার মধ্যে ফাইল নোটিং, লগবুক, সব কিছুকেই রাখা হয়েছে।
পরীক্ষার খাতা পরীক্ষার্থীকে দেখানোর ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে এই আইন সহায়ক হয়েছে। সরকারি কর্মীর ব্যক্তিগত কিছু তথ্য, এবং তৃতীয় পক্ষ বা বেসরকারি সংস্থার কিছু তথ্য পাওয়ার সংস্থানও এতে রয়েছে। আইনে বলা হয়েছে যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে সরকারি কর্মীর জরিমানা হতে পারে, এবং গোপনীয়তা আইন আর তথ্যের অধিকার আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তথ্যের অধিকার আইনই প্রাধান্য পাবে। গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করেছে এই বিধি।
এ তো গেল আইনের ভাল দিক। কিন্তু এই আইনের কেমন রূপায়ণ হল এই কুড়ি বছরে? তথ্য কমিশনারদের পদের মান, বেতন, স্বাধিকার এবং কার্যকালের মেয়াদ কমেছে। তথ্য কমিশনার নিয়োগে কেন্দ্র তথা বিভিন্ন রাজ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিকদেরই বেশি বাছা হয়েছে, যাঁরা চিরকাল গোপনীয়তার শপথ নিয়েছেন, এবং সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে, জনসুবিধার চেয়ে সরকারি কর্মীরা তাঁদের চাকরির খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই বেশি আবেদন করেছেন। অনেকে এই আইনের সুযোগ নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছেন। সব রাজ্যেই তথ্য কমিশনে শূন্য পদ আর জমে-থাকা আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক রাজ্যে রাজধানী ছাড়া অন্যত্র তথ্য কমিশন নেই। সরকারকে যা বিব্রত করতে পারে, এমন তথ্য দেওয়া এড়ানো হয়।
তার উপর একাধিক সংশোধনী, এবং নতুন নানা আইন এনে তথ্যের অধিকার আইনের দাঁত ভাঙার ব্যবস্থাও জারি। ‘ডিজিটাল পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন আইন’-সহ আরও কয়েকটি তথ্য প্রযুক্তির আইন অনেক তথ্যকে ব্যক্তিগত হিসাবে চিহ্নিত করে তথ্যের অধিকার আইনে তা দেওয়া যাবে না বলে নিদান দিয়েছে। দুঃখের কথা, যে সব সমাজ-সচেতন নাগরিক তথ্যের অধিকার আইনকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করছিলেন, তাঁদের উপর নেমে এসেছে আক্রমণ। প্রায় একশো জন খুন হয়েছেন, আড়াইশো জনেরও বেশি শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রায় সমান সংখ্যক নাগরিককে ভয় দেখানো হয়েছে, বলছে ‘কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ’ সংস্থার প্রতিবেদন। এই আইনের দু’-দশক পূর্তির দিনই আমদাবাদে বিশেষ ভাবে সক্ষম এক তথ্যের অধিকার কর্মী, যিনি গত এক দশকেরও বেশি সময় বহু দুর্নীতি ফাঁস করেছেন, তিনি অপহৃত হন। একটি খালের ধারে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়।
ভারতে ‘হুইসলব্লোয়ার’-দের নিরাপত্তা দেওয়ার আইন প্রস্তাবিত হয়েছে ২০১১ সালে, পাশ হয়েছে ২০২৪ সালে, কিন্তু আজও চালু হয়নি। যাঁরা দুর্নীতির তথ্য সামনে আনেন, তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা এই আইনের। অতএব দু’দশক পূর্তির বছরে নিশানা করতে হবে তথ্যের অধিকার আইনকে ফের শক্তিশালী করে তোলার। তথ্য কমিশনগুলিকে সক্রিয় করা, এবং হুইসলব্লোয়ার নিরাপত্তা আইন কার্যকর করার লক্ষ্যে এগোতে হবে। নয়তো মানুষের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। গণতন্ত্রও।