• রাজীব গান্ধী সরকার নাড়িয়ে দিয়েছিল শাহ বানো মামলা, ফিরে দেখা সেই ইতিহাস
    প্রতিদিন | ০৮ নভেম্বর ২০২৫
  • বিশ্বদীপ দে: সদ্য মুক্তি পেয়েছে ‘হক’ ছবিটি। তাকে কেন্দ্র করে ফের আলোচনায় উঠে এসেছে একটা নাম। শাহ বানো। ইতিহাস যে আসলে অতীত মাত্র নয়, সে কেবলই বয়ে চলে সময়ের কিনারে, তা যেন প্রমাণ হয়ে গেল আরও একবার। এই প্রজন্মের কাছে হয়তো নামটা অতটা পরিচিত নয়। কিন্তু গত শতকের আটের দশকে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক, তাঁদের স্মৃতিতে নিশ্চয়ই রয়ে গিয়েছে সবটা। এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব শাহ বানো মামলা ও তৎকালীন ভারতবর্ষের গল্প।

    ১৯৩২ সালে বিয়ে হয় শাহ বানো ও মহম্মদ আহমেদ খানের। তাঁদের পাঁচ সন্তান। তিন পুত্র, দুই কন্যা। বড় মেয়ে সিদ্দিকিয়ার বিয়েও হয়ে গিয়েছে। এরকম এক সময়ে ইন্দোরের বিখ্যাত আইনজীবী আহমেদ সাহেব তিন তালাক দিলেন স্ত্রীকে! সেই সময় শাহ বানোর বয়স ৬২। স্ত্রীকে কোনও খোরপোষ দিতে রাজি হননি মহম্মদ আহমেদ। অগত্যা আদালতে পিটিশন দাখিল করেন শাহ বানো। সেটা ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাস।

    মনে রাখতে হবে, তিন বছর আগেই কিন্তু স্ত্রীকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বলেছিলেন আহমেদ। তিনি ততদিনে দ্বিতীয় বার বিয়ে করে সেই বাড়িতেই বাস করতে শুরু করেছেন। শাহ বানো ফৌজদারি আইনের ১২৩ ধারায় তাঁর ও পাঁচ সন্তানের জন্য খোরপোষ দাবি করলেন। সেই আইনে পরিষ্কার বলা ছিল, একজন স্বামী বিয়ের পর এবং বিচ্ছেদের পরও তাঁর খরচের অর্থ জোগাতে বাধ্য, যদি স্ত্রীর রোজগারের অন্য কোনও উপায় না থাকে। এই দাবির বিরোধিতা করলেন আহমেদ। তাঁর দাবি ছিল, মুসলিম পার্সোনাল আইনে খোরপোষ দেওয়ার কোনও নিদান নেই। কেবলমাত্র ডিভোর্সের পরে ইদ্দাতের সময় তা দেওয়া যেতে পারে। ইদ্দাত হল এমন একটা সময়পর্ব যেখানে একজন মহিলার স্বামী মারা গেলে কিংবা তাঁর ডিভোর্সের পরে ফের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সময়কালকে বোঝানো হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইদ্দাতের সময় নির্দিষ্ট। তবে সাধারণত সেটা তিনমাসের বেশি লম্বা হয় না। একমাত্র ব্যতিক্রম, যদি ওই মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে সন্তান জন্ম পর্যন্ত আর্থিক সাহায্য দিতে হবে।

    আহমেদকে সমর্থন করে এল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড। তারা জানিয়ে দেয়, ১৯৩৭ সালের শরিয়ত আইন অনুযায়ী, এই বিষয়টায় আদালতের নির্দেশ দেওয়ার স্বাধীনতা নেই। বরং তা মুসলিম ব্যক্তিগত আইের অধীনে। এর অন্যথা হলে সেই আইন বিঘ্নিত হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়ে দেয়, সমস্ত ধর্ম নির্বিশেষে ১৯৭৩ সালের ফৌজদারি আইনের ওই ধারাটি সমস্ত ভারতীয়র জন্যই প্রযোজ্য। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় শাহ বানোকে ভরণপোষণের নির্দেশ দেওয়া হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। বরং সুপ্রিম কোর্ট ভরণপোষণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করে। আজও ওই মামলাকে এদেশের ন্যায়ক্ষেত্রে এক মাইলফলক হিসেবেই ধরা হয়। গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে এমন রায়ের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

    কিন্তু ঘটনার সেখানেই শেষ নয়। ১৯৮৬ সালে পাস হয় মুসলিম মহিলা (তালাকের সুরক্ষা) আইন। এই আইনে শাহ বানো মামলার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। এবং সেখানে ফের পুরনো কথা ফিরিয়ে এনে বলা হয় কেবলমাত্র ইদ্দতের সময়ই ভরণপোষণ দিতে হবে। পাশাপাশি আরও বলা হয়, যদি কোনও মহিলা উপার্জনক্ষম না হন, তাহলে ইদ্দত পর্বের পরে, ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াকফ বোর্ডকে নির্দেশ দিতে পারেন ওই মহিলা ও তাঁর উপর নির্ভরশীল সন্তানদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে দেওয়া। সেই সময় কেন্দ্রের ক্ষমতায় রাজীব গান্ধী সরকার। নিঃসন্দেহে এই ঘটনায় প্রশাসন চাপে পড়ে যায়।

    এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করেন শাহ বানোর আইনজীবী দানিয়াল লাতিফি। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, নয়া আইন মেনে নিয়েও বলা যায়, স্বামীর দায় কেবল ইদ্দতেই শেষ হয়ে যেতে পারে না। নারী-পুরুষের সাম্য (বিশেষ করে বিবাহের ক্ষেত্রে) বিষয়ে এই রায়কে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু শাহ বানো পরে আচমকাই সরে আসেন খোরপোষের দাবি থেকে।
    এরপর জাম্প কাট টু ২০১৯। দ্বিতীয় বারের জন্য সদ্য ক্ষমতায় এসেছে মোদি সরকার। সেবছরের ১ আগস্ট থেকে কার্যকর একটা নতুন আইন। যে আইনের নাম ‘মুসলিম নারী (বিবাহ অধিকার সুরক্ষা) আইন, ২০১৯’। যাতে বলা হল, তাৎক্ষণিক তিন তালাক দিলে স্বামীর তিন বছরের জেল হবে। দিতে হবে জরিমানাও। এর আগে ২০১৭ সালেই সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করেছিল। আর এই আইনে বলা হয়েছিল বিবাহ বিচ্ছেদের পরও মুসলিম মহিলাদের এবং তাঁদের সন্তানদের ভরণপোষণের অধিকার রয়েছে।

    তবে এই রায় শাহ বানো জেনে যেতে পারেননি। উচ্চ রক্তচাপ ও ঘনঘন অসুস্থতার পরে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় তাঁর। বলা হয়, দেশজুড়ে লাগাতার চলতে থাকা বিতর্কের জেরেই এই অসুস্থতা। তবে তিনি না থাকলেও মেয়েদের অধিকার রক্ষার কথা যখনই হবে এদেশে, শাহ বানোকে বাদ দিয়ে সেই আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না।
  • Link to this news (প্রতিদিন)