তদন্তের বোঝায় ন্যুব্জ সিবিআই, তবু হস্তান্তর একের পর এক মামলা! প্রশ্নের মুখে আদালতের ভূমিকা, বাস্তব ‘শাঁখের করাত’ও
আনন্দবাজার | ০৮ নভেম্বর ২০২৫
পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে কতগুলি তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে?
উত্তর: ৫০০-র বেশি।
কলকাতায় সিবিআইয়ের লোকবল কত?
উত্তর: ৩০০-র কম।
এ রাজ্যে সাধারণ পরিস্থিতিতে সিবিআইয়ের একজন তদন্তকারী আধিকারিককে একসঙ্গে ৫-৬টি মামলার দায়িত্ব সামলাতে হয়। তার মধ্যে বিভিন্ন পুরনো মামলার বিচারে হাজিরা দেওয়া, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করানো, সওয়াল-জবাবে উপস্থিত থাকা-সহ নানা রুটিন কাজ থাকে। কিছু গোপন নজরদারি, ঘুষ বা আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ সংক্রান্ত কাজও থাকে। এর পরে রয়েছে ‘ওজনদার মামলা’।
কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবীদের একাংশ মনে করেন, সিবিআইয়ের লোকবল এবং তাদের হাতে থাকা মামলার সংখ্যার কথা আদালতের মাথায় রাখা উচিত। প্রবীণ আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের কথায়, ‘‘আমি অনেক দিন ধরেই এ কথা বলে আসছি যে, এত মামলার চাপ একসঙ্গে সামলানোর ক্ষমতা সিবিআইয়ের নেই।’’ পশ্চিমবঙ্গে একাধিক মামলার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিক আদালতে ভর্ৎসিত হচ্ছেন। কখনও সময়মতো তদন্ত শেষ করতে না-পারায়। কখনও তদন্তের অগ্রগতি বিচারপতির আশানুরূপ না-হওয়ায়। কখনও আবার সিবিআইয়ের তদন্তকারী দলের ‘সদিচ্ছা’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে এই ‘সদিচ্ছা’ সংক্রান্ত প্রশ্ন আদালত নয়, অন্যান্য পক্ষও তুলেছে। আরজি কর মামলার তদন্তের ক্ষেত্রেই যেমন নির্যাতিতার বাবা-মা বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন এক মহিলা আধিকারিকের কাজের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। সেই অভিযোগের সত্যতা যে থাকতেও পারে, তেমন আভাস মিলেছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বয়ানে। আরজি করের নির্যাতিতার পরিবারের কাছ থেকে ওই আধিকারিক সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ চেয়ে নিয়েছিলেন মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এবং তা ‘উপযুক্ত স্থানে’ পৌঁছে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এমন ঘটনা কমই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজের চাপ এবং লোকাভাবই প্রধান অন্তরায় হচ্ছে বলে সব পক্ষই মানছে।
খাতায়-কলমে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। সুতরাং রাজ্যের সীমানায় হওয়া অপরাধ বা দুর্নীতির তদন্তভার রাজ্য পুলিশের হাতে থাকাই আদর্শ। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পুলিশ-প্রশাসনে রাজনীতির প্রভাব বেশি থাকায় বিভিন্ন উচ্চ গুরুত্বের মামলায় তদন্তকারীদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। অতএব কেন্দ্রীয় তদন্তের দাবি ওঠে এবং তাতে আদালত সিলমোহরও দেয়। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, কয়েকটি ক্ষেত্রে সিবিআই তদন্তের নির্দেশের ফলে রাজনৈতিক হইহল্লা সাময়িক প্রশমিত হচ্ছে। কিন্তু ন্যায় আদৌ মিলছে কি না, সে প্রশ্ন দিন দিন বড় হচ্ছে।
সিবিআই তদন্ত চেয়ে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা পুলিশের প্রতি ক্রমবর্ধমান অনাস্থারই প্রতিফলক। তবে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের উপরে সাধারণের আস্থা হাল আমলে কমেনি। পুলিশকে রাজনৈতিক রং দেখতে বাধ্য করার অভিযোগ বাম জমানাতেও অহরহ উঠত। এখনও যা বহাল। রাজনৈতিক প্রভুদের নির্দেশ না মানলে পুলিশকর্তাদের কী হাল হতে পারে, কে জয়রামন বা দময়ন্তী সেনের মতো আইপিএসরা তার উদাহরণ। বাম জমানায় জঙ্গলমহলে সন্ত্রাস ও খুনে অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে সিপিএমের রোষানলে পড়েছিলেন তদানীন্তন ডিআইজি, সিআইডি (অপারেশন্স) জয়রামন। দ্রুত বদলির নির্দেশ এসেছিল। তৃণমূল জমানায় ফের তিনি সরকারের রোষে পড়েন দুর্নীতির অভিযোগে আইএএস গোদালা কিরণ কুমারকে গ্রেফতার করে। আর পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে সরকারের পছন্দসই পথে না চলায় দময়ন্তী বদলি হয়ে যান ডিআইজি (প্রশিক্ষণ)-এর মতো গুরুত্বহীন পদে। এই সব কারণেই পুলিশি তদন্তে আস্থা কম। সিবিআই তদন্ত চাওয়ার প্রবণতা বেশি।
কলকাতা হাই কোর্ট সূত্রের দেওয়া গত কয়েক দশকের হিসাব বলছে, বছরে তিন-চারটি করে মামলা আদালতের নির্দেশে সিবিআইয়ের হাতে যেত। অধিকাংশই এমন মামলা, যাতে একাধিক রাজ্যে তদন্ত চালাতে হতে পারে। অথবা ‘হিবিয়াস কর্পাস’ (নিখোঁজ) মামলা। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আদালত দিয়েছে, আগে কখনও এত কম সময়ে এতগুলি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হয়েছে বলে আইনজীবীরাও মনে করতে পারছেন না।
রাজ্যের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে, এ রকম কতগুলি মামলা এই মুহূর্তে সিবিআইয়ের হাতে?
১. বগটুই গণহত্যা মামলা, যা এখনও নিষ্ফলা। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সিবিআই আধিকারিকেরা আদালতের প্রশ্নের মুখে পড়েছেন তো বটেই। পাশাপাশি সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে সিআইডি তদন্তও শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ, সিবিআই হেফাজতে রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছিল ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত লালন শেখের।
২. নদিয়ার হাঁসখালিতে ধর্ষণের তদন্তও সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছিল। সে মামলায় সিবিআই কিছুটা সাফল্য পেয়েছে। নিম্ন আদালতে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্তও হয়েছে। তবে সে রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে অপরাধীর পরিবার। ফলে মামলাটিতে সিবিআইকে এখনও সময় দিতে হচ্ছে।
৩. স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ এবং প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে অন্তত পাঁচটি আলাদা মামলা রয়েছে। সবক’টির তদন্তই সিবিআইয়ের হাতে। পুর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তও করছে সিবিআই।
৪. সন্দেশখালিতে ইডির উপরে হামলা এবং শাহজাহান শেখের অন্যান্য বেআইনি কার্যকলাপের মামলা নিয়ে একটি তদন্ত চলছে। ২০১৯ সালে সন্দেশখালির তিন বিজেপি কর্মীর খুনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আরও একটি তদন্ত চলছে।
৫. গরু পাচার মামলার সিবিআই তদন্ত।
৬. কয়লা পাচার মামলার সিবিআই তদন্ত।
৭. আরজি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতে দু’টি আলাদা মামলার তদন্ত করছে সিবিআই। একটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায়। অন্যটি দুর্নীতির।
৮. নদিয়ায় এক রাজনৈতিক কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর নেপথ্যে পুলিশের ভূমিকার অভিযোগ ওঠায়, তাতেও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হয়েছিল।
৯. ২০২১ সালের অনেক আগে থেকে এ রাজ্যের তিনটি বড় মামলার তদন্ত করছে সিবিআই। নারদ ঘুষকাণ্ড, চিটফান্ড কাণ্ড এবং রিজ়ওয়ানুর কাণ্ড।
১০. এ ছাড়া ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’ সংক্রান্ত একগুচ্ছ মামলা রয়েছে। জেলায় জেলায় আলাদা আলাদা মামলা। তার তদন্তও আলাদা আলাদা ভাবে। তার মধ্যে কলকাতার কাঁকুড়গাছিতে বিজেপি কর্মী অভিজিৎ সরকারকে পিটিয়ে খুনের ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে নন্দীগ্রামে এক মহিলার যৌন হেনস্থার অভিযোগ। কোচবিহারের উদয়ন গুহ বা পূর্ব বর্ধমানের খোকন দাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বা পার্থ ভৌমিকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তও।
সব মিলিয়ে রাজনৈতিক ভাবে ‘সংবেদনশীল’ মামলার সংখ্যা অন্তত ১৮টি। তার সঙ্গে জেলায় জেলায় ভোট পরবর্তী হিংসার মামলাগুলি ধরলে সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ, সিবিআইয়ের হাতে সাধারণ ভাবে যত মামলা থাকে, তার পাশাপাশি আরও অন্তত ৩০-৩৫টি অতিরিক্ত মামলার ভার চেপেছে। প্রায় প্রতিটি মামলাই উচ্চ গুরুত্বের।
সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমানের রায়নায় এক নাবালিকার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় কলকাতা হাই কোর্ট সিবিআই তদন্তের রায় দিয়েছিল। সেই নাবালিকাকে খুঁজে আনতে সিবিআই সক্ষম হয়েছে। তা ছাড়া সাফল্যের ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। কারণ, আরজি কর কাণ্ডে সঞ্জয় রায়ের সাজা ঘোষণা হওয়াকে সিবিআইয়ের ‘সাফল্য’ হিসাবে কেউই দেখছেন না। এমনকি, কলকাতা হাই কোর্টের কোনও কোনও বিচারপতিও এখন সিবিআইকে নতুন কোনও তদন্তের ভার দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে দু’জনের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাতেও সিবিআই তদন্তের আবেদন জমা পড়েছিল। কিন্তু বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেননি। উল্টে মন্তব্য করেছিলেন, সিবিআই ‘গ্যালারি শো’ করছে। কাজের কাজ হচ্ছে না।
বিচারপতির এই ভর্ৎসনা সিবিআইয়ের প্রাপ্য কি না, সে প্রশ্নও সংস্থার কয়েকজন আধিকারিক তুলছেন। লোকবলের কথা না ভেবে হাই কোর্ট কেন গুচ্ছ গুচ্ছ মামলা সিবিআইকে হস্তান্তর করছে, সে প্রশ্নও উঠছে। কলকাতা হাই কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি অরুণাভ বলছেন, ‘‘হাই কোর্টেও তো লোকাভাব! কলকাতা হাই কোর্টে ৭২ জন বিচারপতি থাকার কথা। দীর্ঘ দিন ৩৬ জন নিয়ে কাজ চলছিল। তাই আদালত কোনও বিষয়ই আর বেশি দিন নিজের কাঁধে রাখতে চায় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেয়।’’ ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল রাজদীপ মজুমদার অবশ্য সে তত্ত্ব মানতে নারাজ। সিবিআইয়ের হয়ে একাধিক মামলায় সওয়াল করেন তিনি। রাজদীপের কথায়, ‘‘আদালত সব দিক খতিয়ে না দেখে কখনওই কেন্দ্রীয় তদন্তের নির্দেশ দেয় না। আগে কেস ডায়েরি তলব করে। পুলিশ বা রাজ্যের সংস্থা কী ভাবে কাজ করেছে, তা বুঝে নেয়। দু’পক্ষকেই বিশদে সওয়াল-জবাবের সুযোগ দেয়। তার পরে সিদ্ধান্তে পৌঁছয়।’’
এমন ‘শাঁখের করাত’ পরিস্থিতির নিরসন কোন পথে, কেউই নিশ্চিত নন। তবে আইনজীবীদের একাংশের মতে, হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা বাড়লে পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হতে পারে। প্রবীণ আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা, সব বিচারক সব আইন জানবেন বা প্রতিটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন, এমনটা সম্ভব নয়। তাই যিনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, সেই বিষয়ের মামলা তাঁর এজলাসেই যাওয়া জরুরি। কিন্তু কলকাতা হাই কোর্টে এই মুহূর্তে বিচারপতির সংখ্যা ৪৫। অর্থাৎ ২৭টি পদ খালি। পরিস্থিতি এ রকম হলে স্বাভাবিক কারণেই বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞের সংখ্যাও কমে যায়। সে ক্ষেত্রে আদালতের সব নির্দেশ ‘যৌক্তিক’ বলে মনে না-ও হতে পারে।