• ভোটের লাইনে কি থাকবেন গোলাপিরা? প্রশ্ন জঙ্গলমহলে
    এই সময় | ১০ নভেম্বর ২০২৫
  • প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া

    গোলাপি শবর। জঙ্গলমহলের বলরামপুরের হাড়জোড়া গ্রামের বাসিন্দা মন্টু শবরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বছর দশ-বারো আগে।

    রাইমণি শবর। তিনিও এই গ্রামের বধূ। বছর দশেক আগে লালমোহন শবরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। দীর্ঘ তালিকায় রয়েছে মৌসুমী শবর, ঝুমি শবর, জলেশ্বরী শবর, অম্বিকা শবর। ঘটনা হলো, এঁদের অনেকেরই কাছে প্রয়োজনীয় সেই নথি নেই, যা দাখিল করলে এই মুহূর্তে রাজ্য জুড়ে চলা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় (সার) তাঁদের নামও থাকবে।

    গোলাপি অথবা রাইমণি এই মুহূর্তে বলরামপুর বিধানসভার আওতাধীন হাড়জোড়া গ্রামের ভোটার হলেও তাঁদের নথি দেখানোর কথা বলা হয়েছে। তার কারণ, এঁদের বাপের বাড়ি লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন গ্রামে। এবং তারই সঙ্গে ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় কারও নাম নেই!

    গ্রামের শবরটোলার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ভোটার তালিকা নিয়ে সম্প্রতি বিএলও এসেছিলেন। তালিকা ধরে তিনি জানিয়ে গিয়েছেন, বাপের বাড়ি থেকে মা–বাবার যাবতীয় নথি নিয়ে আসতে হবে, যেটা দেখা বোঝা যাবে তাঁরা সেখানকার পুরোনো বাসিন্দা, অথবা ২০০২ ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম ছিল।

    গোলাপির স্বামী মন্টু পরিযায়ী শ্রমিক, কাজের সূত্রে থাকেন ভিন রাজ্যে। গোলাপির বাপের বাড়ি ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার মোহনপুর গ্রামে। গোলাপি বলছেন, ‘আমার নাম গ্রামের ভোটার তালিকায় আছে, কিন্তু তার পরেও মা–বাবার কাগজ আনতে বলা হয়েছিল। সেখান থেকে ওঁদের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র ও ব্যাঙ্কের পাশবইয়ের ফোটোকপি নিয়ে এসেছি। কিন্তু বিএলও তা বাতিল করে দিয়েছেন।

    রাইমনির স্বামী লালমোহনও পরিযায়ী শ্রমিক, রয়েছেন ভিন রাজ্যে। গ্রামের ভোটার তালিকায় রাইমণির নাম থাকলেও পুরোনো তালিকায় তাঁর নাম নেই। বিএলওর পরামর্শ মেনে তিনিও ছুটেছিলেন ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা-খরসঁওয়া জেলার নিমডি থানার ভাঙাট গ্রামে।

    নথি বলতে মা–বাবার আধার কার্ড এবং সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র। ছিল জমি সংক্রান্ত নথির ফোটোকপি। কিন্তু বিএলও তা নাকচ করে দিয়েছেন। একই অভিজ্ঞতা জলেশ্বরীর। তিনিও ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা-খরসঁওয়া জেলার নিমডি থানার মাকুলা গ্রামে গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন নথি, তবে তা গ্রাহ্য করা হয়নি।

    হাড়জোড়া গ্রামেরই বাসিন্দা জিতেন মাজি এখন শবরটোলার বাসিন্দাদের এনিউমারেশন ফর্ম পূরণে সহায়তা করছেন। তিনি বলছিলেন, ‘জলেশ্বরীর বাপের বাড়ি ঝাড়খণ্ডের ইচাগড় বিধানসভা এলাকায়। কোনও নথিই পায়নি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ২০০৩ সালের ভোটার তালিকার ফোটোকপি নিয়ে এসেছে। সেই তালিকায় ওঁর মা–বাবার নাম রয়েছে বটে, কিন্তু নামের পাশে যে আইডি নম্বর থাকে, সেটা ফাঁকা। ফলে বিএলও তা দেখার পরে কিছুই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।’

    জিতেন জানাচ্ছেন, এমন মহিলাও রয়েছেন যাঁরা এই জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিবাহসূত্রে এখানে এসেছেন। কিন্তু তাঁরাও বাপের বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় নথি আনতে পারেননি। যেমন দেবেন শবরের স্ত্রী শ্রীমতী শবর। প্রায় দু’দশক আগে বিয়ে হয়েছিল।

    শ্রীমতী বলছেন, ‘বাপের বাড়ি বরাবাজার থানার জাহানাবাদ গ্রামে। ছোটবেলায় বাবার মৃত্যু হয়। মা–র সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র এনেছি। কিন্তু তা দিয়ে কিছু হবে না বলে জানিয়েছেন বিএলও। ফের জাহানাবাদে গিয়ে দেখতে হবে, আর কী কাগজ রয়েছে।’ জাহানাবাদ গ্রাম থেকে এখানে আসা আর এক মহিলা লতিকা শবরের মন্তব্য, ‘বাবা নেই, মায়ের আধার কার্ড এনেছি। সেটা গৃহীত হয়নি। ও দিকে মা জানিয়েছেন, সেটা বাদে আর কোনও কাগজই নেই।’

    বলরামপুর বিধানসভার আওতাধীন ২৩৯-১৭০ নম্বর বুথের বিএলও চম্পকবরণ মাজির ব্যাখ্যা, ‘এই বিধানসভায় ৬৫ শতাংশ ভোটারের ম্যাপিং হয়ে গিয়েছে। বাকি ৩৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মা–বাবার ২০০২ সালের তালিকায় এবং ঝাড়খণ্ডের হলে ২০০৩ সালের তালিকায় নাম রয়েছে, এমন তথ্য দিতে হবে। যে ভাবে ফর্ম পূরণের নির্দেশ রয়েছে, সেই তথ্য অনেকের কাছেই নেই। ফর্ম পূরণ না–করলে ওঁদের শুনানি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেখানে ১৯৮৭ সালের আগের কী সরকারি নথি রয়েছে, তা দেখা হবে।’

    হতাশ জিতেন বলছেন, ‘শবররা নিজেদের প্রতিই এত উদাসীন যে, শরীর খারাপ হলে পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যায় না। নথি জোগাড় করতে বললেও খুব একটা গা করছে না। ওরা মনে হয় ‘সার’–এর গুরুত্বটা বুঝতে পারছে না।’ পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া-শবর কল্যাণ সমিতির অধিকর্তা প্রশান্ত রক্ষিতের তথ্যানুযায়ী, ‘জেলায় ১১টি ব্লকে শবরদের বাস থাকলেও আটটি ব্লকে ওঁরা বেশি সংখ্যায় আছেন। ওদের মোট সংখ্যা ১৪,০৪০। সিংহভাগের কাছে নথি নেই।’

    তিনি যোগ করলেন, ‘বিধি মোতাবেক যে নথি–সহ ফর্ম পূরণ করতে হবে, অনেকেই তা পারবে না। সকাল থেকেই যাদের খাবারের চিন্তা করতে হয়, তারা কী ভাবে নথি সংরক্ষণ করবে? ওরাও তো এই দেশের নাগরিক, কিন্তু তাঁদের নথি নেই। প্রশাসনকেই নথি তৈরি করে দিতে হবে। না–হলে ওরা কোথা থেকে তা পাবে?’

    ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের পরে সরকার গড়ার লাইনে কি দেখা যাবে গোলাপি, রাইমণিদের? উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছে জঙ্গলমহল।

  • Link to this news (এই সময়)