• দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্স’! কথায়-কাজে দু’মুখো কেন্দ্র, বিশ্ব ব্যাংকের ৮ বছর আগের সুপারিশ উপেক্ষা
    বর্তমান | ১০ নভেম্বর ২০২৫
  • বাপ্পাদিত্য রায়চৌধুরী, কলকাতা: নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে বিদেশ থেকে সব কালো টাকা ফিরিয়ে আনবেন। ১১ বছর কেটে গিয়েছে। কালো টাকা ফেরত আসেনি। প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলের ঘোষণা করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আর্থিক নয়ছয়, জাল নোটের জমানা শেষ হয়ে গেল। প্রায় সব ৫০০-হাজার টাকার নোটই ফিরে এসেছিল রিজার্ভ ব্যাংকের কোষাগারে। সেটাও ৯ বছর আগে। নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন দুর্নীতি মুক্ত দেশের। এই ব্যাপারে তিনি নাকি ‘জিরো টলারেন্স’। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করার মতো কোনও পদক্ষেপ সরকারিভাবে দেখা যায়নি। এই দাবি কার? খোদ বিশ্ব ব্যাংকের। সম্প্রতি ভারতের অর্থনীতি সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তারা। তাতে তারা সাফ জানিয়েছে, আর্থিক দুর্নীতি গোড়া থেকে কেটে ফেলার কোনও উদ্যোগই মোদি সরকার নেয়নি। অর্থাৎ, সেই প্রকাশ্যে কেন্দ্রের দু’মুখো নীতি। মুখে যা, কাজে তার প্রতিফলন নেই।

    ভারতের আর্থিক স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্কারের একটি রুটম্যাপ ২০১৭ সালে দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক। সেখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বিমা, শেয়ার বাজার সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কারের সুপারিশের পাশাপাশি, দেশের নেতা, মন্ত্রী, শিল্পপতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আর্থিক অনিয়ম বন্ধের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক জানিয়েছিল, এর জন্য ভারত সরকারকে সুনির্দিষ্ট আইনি ঘেরাটোপ তৈরি করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মন্ত্রী, আমলা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনেকেই ক্ষমতার জোরে দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়েন। যথাযথ কর না মিটিয়ে কালো টাকার পাহাড়ে চড়ে বসেন তাঁরা। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সুপারিশ ছিল, এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে। কালো টাকা যাতে কোনওভাবে পাচার না হয়, তার জন্য আগাম আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে সেই সুপারিশের প্রসঙ্গ টেনে স্পষ্ট জানিয়েছে, তাদের সুপারিশকে পাত্তাই দেওয়া হয়নি। টাকা পাচার রোখার কোনও উদ্যোগ নেয়নি নরেন্দ্র মোদি সরকার। এমনকি, ব্যাংকগুলিকে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হচ্ছে না বলেও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার তির দেগেছে বিশ্ব ব্যাংক। আট বছর আগের সুপারিশ ছিল, আইনে বদল এনে আরবিআইকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হোক, যাতে তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যাংকগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পাশাপাশি তাদের আইনি স্বাধীনতার বহর বাড়ানে হোক। সেক্ষেত্রেও যে মোদি সরকার এক কদম এগোয়নি, তা সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানিয়েছে তারা। অর্থাৎ ব্যাংক কীভাবে তাদের ব্যবসা চালাবে, কাকে টাকা ধার দেবে বা কাকে দেবে না, সেই বিষয়ে যাতে তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেই স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যাখ্যা, এমনটা করতে গেলে কেন্দ্রের শাসকদলের একাধিক ‘এজেন্ডা’ ধাক্কা খাবে। আর্থিক ক্ষমতাও আর দিল্লির দরবারে কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না। তাই আইন বদল করে নিজেদের খবরদারি আটকানোর কোনও চেষ্টাই করেনি কেন্দ্র। অর্থাৎ, দুর্নীতি-নাশ দূরঅস্ত, তার রাস্তাগুলিকেও স্বযত্নে আগলে রেখেছে তারা।

    ভারতের অর্থনীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে, তার রূপরেখা তৈরিতে কয়েকটি মাপকাঠি সামনে এনেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। সেখানেও দেশের ‘বিকাশে’র বিশেষ আভাস মেলেনি। যেমন, দেশের জিডিপি ১০০ টাকার হলে, ঋণের বোঝা চলতি অর্থবর্ষ শেষে ৮১.৮ টাকায় পৌঁছোতে পারে ধারণা তাদের। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে তা ছিল ৮১.৭ টাকা। গত অর্থবর্ষে ৮২.৪ টাকা। অর্থাৎ পরিস্থিতির উন্নতি নেই। চলতি অর্থবর্ষে জিডিপি পিছু সরকারের রাজস্ব আদায় ২০.৭ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তা গত অর্থবর্ষে ২০.৯ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ উপসংহার একটাই—পরিস্থিতি নিম্নগামী।
  • Link to this news (বর্তমান)