• নাম বাদ দিয়েছে, এরপর দেশছাড়া করবে: তেজস্বী, এসআইআরে আতঙ্ক সীমাঞ্চলে, রেশ বাংলাতেও
    বর্তমান | ১০ নভেম্বর ২০২৫
  • শুভঙ্কর বসু, কিষানগঞ্জ: পূর্ণিয়ার আসমা বা রাজিয়া। কিষানগঞ্জের জুলেখা বা কেশব পাসোয়ান। ঠিকানা বদলে যায়। নামও। বদলায় না শুধু আতঙ্কের ছবি। কারণ, এসআইআরের চূড়ান্ত তালিকায় তাঁদের কারও নাম নেই। কারণ, সরকার তাঁদের পাশে নেই। তাঁদের মনে এখন একটাই শঙ্কা—এসআইআর থেকে নাম বাদ দিয়েছে। এবার দেশছাড়া করবে। 

    সীমাঞ্চল। বিহারের ম্যাপের ধার ধরে হাঁটতে শুরু করলে যে জেলাগুলি ছুঁয়ে যেতে হবে, সেই সবই এই সীমাঞ্চলের মধ্যে পড়ে। তার বেশ কয়েকটি বাংলা লাগোয়া। আজ বাদে কাল এই অঞ্চলজুড়েই বিহারের দ্বিতীয় দফার ভোট। আর এসআইআর যদি কারওকে হাতে ও ভাতে মেরে থাকে, তাহলে তা এই সীমাঞ্চলের সোপৌল, পূর্ণিয়া, আরারিয়া, কাটিহার, কিষানগঞ্জ। মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের জুলেখার বিয়ে হয়েছিল কিষানগঞ্জের রউফের সঙ্গে। বছর ১২ আগে। জুলেখা তখন আঠারো পেরোননি। কিষানগঞ্জের বেলওয়া কাশীপুর গ্রামে গিয়ে ওঠার পর আধার, ভোটার, রেশন কার্ড সবই রয়েছে তাঁর। কিন্তু এসআইআরের পর ভোটার তালিকায় নামটা নেই। স্বামী রউফের পরিচয়পত্র দাখিল করেও লাভ হয়নি। এসআইআর পর্বে বাড়ি ফিরতে না পারায় ‘পরিযায়ী’ রউফের নামও কাটা গিয়েছে। তিন সন্তান নিয়ে তাই আতঙ্কের প্রহর গুনছেন জুলেখা। শুধু তিনি নন। সীমাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের দিকের এমন বহু ‘নাগরিক’ও। তাঁরা সবাই এখন ‘ঘুসপেটিয়া’। তাঁরা সবাই এখন আশঙ্কায়, এবার অ-নাগরিক বলে দেগে দিয়ে দেশছাড়া করে দেওয়া হবে। এলাকার শাসক দলের নেতারাই সেই ভয় দেখিয়ে চলেছেন। আর তাতেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বিরোধী মহাজোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তেজস্বী যাদব। তিনি সাফ বললেন, ‘পুরোটা চক্রান্ত। সীমাঞ্চলের এই এলাকার ভোটারদের নাম বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে। বহু মুসলিম নাগরিককে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বারবার তাঁরা আবেদন করেছেন। কিন্তু শুনানি হয়নি। উলটে তাঁদের বাদ দিয়ে এক একটা এলাকায় ৪০০-৫০০ অ-মুসলিম ভোটারের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, মিথ্যা মামলায় এই ভোটারদের নাম জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাকেও প্রাণে মারার চেষ্টা চলছে। বিজেপি ভেবেছে, এভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে। হবে না। মানুষ খেপে গিয়েছে। আমাদের পক্ষেই মত দেবে বিহার সীমাঞ্চল।’ 

    মানুষ ক্ষুব্ধ। কারণ তাঁরা আতঙ্কিত। মানুষ বিরক্ত। কারণ, কেশব পাসোয়ানরা জীবিত হওয়া সত্ত্বেও এসআইআরে মৃত বলে ঘোষিত। খসড়া তালিকা প্রকাশের পর কেশব হাজিরা দিয়েছিলেন বিডিও দপ্তরে। তাঁকে ৬ নম্বর ফর্ম ফিল আপ করতে বলা হয়। তারপরও চূড়ান্ত তালিকায় নেই তিনি। বিহারের খসড়া ভোটার তালিকায় কিষানগঞ্জ থেকে বাদ গিয়েছে ১ লক্ষ ৪৬ হাজার নাম। কিষানগঞ্জের সাংসদ মহম্মদ জাভেদের সহকারী এহেসানের দাবি, ‘কিষানগঞ্জ, পূর্ণিয়া, কাটিহারে ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বিজেপি নেতাদের তৈরি করে দেওয়া তালিকা অনুযায়ী।’

    খসড়া তালিকায় পূর্ণিয়ার প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের চাপে পড়ে চূড়ান্ত তালিকায় ৮৩ হাজার নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে কমিশন। কিন্তু পূর্ণিয়ার আনাইলি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা আসমা‌, রাজিয়াদের অভিযোগ, ‘গোটা পাড়ায় কেউ ফর্মই দিতেই আসেনি... ফর্ম হি না দিয়া। অউর ইঁউহি নাম ফেক দিয়া। অব রাশন-পানি বন্‌ধ না কর‌ দে।’ স্থানীয় সূর্যাপুরি ভাষায় বলছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত আসমা। এই গ্রামের বিএলও স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার। শাসক ঘনিষ্ঠও। তাঁর দাবি, ‘ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। ওরাই ফর্ম নিতে আসেনি।’ শুধু আনাইলি নয়, আশপাশের পীরগঞ্জ, বাহাদুরপুর, বড়হরি সর্বত্র এক ছবি। বাদ যাওয়া বেশিরভাগই অবশ্য ‘মৃত’। ৮০টি বিধানসভা ক্ষেত্রে মৃত বলে যাঁদের দেখানো হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশেরই বয়স ৫০’এর কম। ভাগলপুরে একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ৫৮ জন মৃত ভোটারের নাম গিয়েছে। তাঁদের ৫০ জনের বয়স ৫০ পেরোয়নি। আনাইলিতেও যাঁদের ফর্ম জমা পড়েনি, স্রেফ মৃত দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই আতঙ্কই জুলেখা-আসমাদের এখন নিত্যসঙ্গী। অদূর ভবিষ্যতেরও।
  • Link to this news (বর্তমান)