নিজস্ব প্রতিনিধি, ঝাড়গ্ৰাম: উত্তর কলকাতার হরি ঘোষ স্ট্রিটকে সাঁওতাল পরগনার ঘোলাটে নদীর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘স্মৃতির শহর ২’ কবিতায়। আসলে জঙ্গলমহলের প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল তাঁর। একাধিকবার গিয়েছেন সেখানে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সহ সুনীলের একাধিক গল্প, উপন্যাসে উঠে এসেছে কাঁকড়াঝোর, বেলপাহাড়ীর অভিজ্ঞতা। শুধু সুনীল নন, শক্তি চট্টোপাধ্যায় সহ তাঁদের বন্ধুদলেরও। সেই বেলপাহাড়ীর অরণ্যে শীত এসে গিয়েছে। বনের পথ আড়াল করে দিচ্ছে ঘন কুয়াশা। বেলপাহাড়ীর উলুখডোবা, তেলিঘানা, বিরগি রুটে ট্রেক করছেন পর্যটরা। দুর্গম এই পথেই হেঁটেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা। পর্যটকদের পায়ে পায়ে সেই ভ্রমণের স্মৃতি ফিরছে।
বেলপাহাড়ীর পাহাড়, জঙ্গলে একসময়ে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষের পা পড়েছিল। সেই বেলপাহাড়ীর টানে এখনও মানুষ ছুটে আসেন। পরিচিত পর্যটনস্থলগুলির পাশাপাশি অফবিট জায়গার টানে আসছেন শহুরে ‘জেন জি’-রা। ভুলাভেদা থেকে উখুলডোবা, বিরগি, নুনঢালা, তেলিঘানা হয়ে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার দুর্গম জংলি পথ রয়েছে। এই পথে অবাধে ঘোরাফেরা করে বন্য প্রাণীরা। স্থানীয় বাসিন্দারা এই পথ ব্যবহারে অভ্যস্ত হলেও বাইরের জগতের মানুষের কাছে পথটি অজানা। সীমিত সংখ্যক পর্যটকই এই পথে ট্রেক করছেন। ইদানীং সেই রোমাঞ্চকর রুটে ট্রেক করার জন্য আগ্ৰহ দেখাচ্ছেন পর্যটকরা। জঙ্গলের এই পথ পর্যটকদের কাছে সুনীল-শক্তি ট্রেক রুট বলে পরিচিত হয়ে উঠছে। গত শতকের ছয় ও সাতের দশকে বেলপাহাড়ীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা একাধিকবার এসেছেন। উখুলডোবা ট্রেক রুট ধরে কাঁকড়াঝোরের দিকে হেঁটে গিয়েছিলেন। বেলপাহাড়ীর এই জঙ্গল সেইসময় আরও দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল ছিল। সুনীল-শক্তিদের জঙ্গলপথে অভিযানের গল্প পর্যটকদের কাছে ট্রেক রুটটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বহু বছর কেটে গেলেও জঙ্গলঘেরা উখুলডোবা থেকে তিলিঘানার পাহাড়ী পথ আজও সমান রোমাঞ্চকর। জঙ্গলের অজানা পথে ঘোরাঘুরি ক্ষেত্রে বনবিভাগ বর্তমানে কিছু নির্দেশিকা জারি করেছে। জঙ্গলে প্লাস্টিক বা বর্জ্য ফেলা যাবে না। জঙ্গলে রাতে তাবু খাটিয়ে থাক যাবে না। সন্ধের আগেই জঙ্গল থেকে ফিরতে হবে। সতর্কতা হিসেবে স্থানীয় টুরিস্ট গাইডদের সাহায্য নিতে হবে। ভুলাভেদা এলাকার বাসিন্দা দিবাকর মান্ডি বলেন, উখুলডোবা, তেলিঘানা হয়ে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার জঙ্গলপথে কিছু পর্যটক এখন যাচ্ছেন। তবে সেই সংখ্যা হাতে গোনা। আগে ওই পথে স্থানীয় মানুষরাও যাতায়াত করত না। জঙ্গলের এই পথটি দিয়ে যাওয়া এখনও ঝুঁকিবহুল। কাঁকড়াঝোরের জঙ্গলে এই বছরের গোড়ায় বাঘের পায়ের ছাপ মিলেছে। বন বিভাগের ট্র্যাপ ক্যামেরায় ভাল্লুকের ছবি ধরা পড়েছে। বেলপাহাড়ী গ্ৰাম পঞ্চায়েতের প্রধান জয়দেব সিংহ বলেন, তেলিঘানার জঙ্গল পথটি খুবই দুর্গম। কাঠুরিয়ারাই শুধু ওই এলাকায় যায়। ওখান থেকে দক্ষিণ পশ্চিম উপত্যকা ধরে গেলে ময়ূরঝর্না দেখতে পাওয়া যাবে। তবে ওই পথে ট্রেক করতে গেলে স্থানীয় মানুষদের সাহায্য নেওয়া দরকার। না হলে বিপদের ঝুঁকি রয়েছে।
বেলপাহাড়ী ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র বিধান দেবনাথ বলেন, শীতে পর্যটকদের আসা শুরু হয়ে গিয়েছে। পর্যটকরা কম পরিচিত জায়গাগুলি ঘুরতে আগ্ৰহ প্রকাশ করছেন। উখুলডোবা-তেলিঘানা ট্রেক রুটটি দিয়ে কবি, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি রয়েছে। কাঁকড়াঝোর, ধলভূমগড় তাঁদের ভ্রমণের মূল ক্ষেত্র ছিল। যার জেরে পর্যটকদের কাছে রুটটির আকর্ষণ আরও বেড়েছে।