‘‘উন্নয়নও সঠিক পথে, ঠিক সময়ে করতে হয়। না-হলে একটা সময়ের পরে সেটাই বিনাশের কারণ হয়ে ওঠে।’’
গত বছর কলকাতায় এসে এই কথাই বলেছিলেন বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী সোনম ওয়াংচুক। যিনি লাদাখের হিমালয়ে ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’র জেরে অরণ্য ধ্বংস, বাস্তুতন্ত্র রক্ষা, জনজাতির স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে চলেছিলেন। সেই ‘অপরাধে’ই গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। চেয়েছে, তাঁর নেতৃত্বে পরিবেশ বাঁচাতে লাদাখবাসীদের আন্দোলনের কোমর ভেঙে দিতে। তাই লাদাখের পরিবেশ রক্ষা এবং সোনমের মুক্তির দাবিতে রবিবার কলকাতার বুকে প্রতিবাদী জমায়েত ও প্রতীকী অনশনে বসল পরিবেশকর্মীদের একটি সংগঠন।
‘ফ্রেন্ডস অব লাদাখ, ফ্রেন্ডস অব নেচার’ নামক ওই সংগঠনের ডাকেই গত বছর শহরে এসেছিলেন সোনম। ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমায় আমির খান অভিনীত ফুনসুক ওয়াংরু চরিত্রটি বাস্তবে যাঁর আদলে তৈরি, সেই সোনম সে বার শুনিয়েছিলেন পরিবেশের ‘আল ইজ় নট ওয়েল’-এর কথা। লাদাখের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার দাবিতে কখনও তিনি ২১ দিন অনশনে বসেছেন, কখনও ষষ্ঠ তপশিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে হেঁটেছেন লাদাখ থেকে দিল্লি। হিমালয়ে বাঁধ তৈরি করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, চার ধাম সড়ক প্রকল্প ও বিভিন্ন উন্নয়নী প্রকল্পের জেরে অরণ্য ধ্বংস, যথেচ্ছ কার্বন নিঃসরণ, স্থানীয়দের জীবনযাপনের উপরে আঘাত হানার প্রতিবাদে সরকারের সঙ্গে আলোচনা, মিছিল সমাবেশ— কোনও পথই বাদ রাখেননি ৫৯ বছরের এই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তথা উদ্ভাবক। কিন্তু তার পরিবর্তে পুলিশের লাঠিচার্জে চার জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে, সোনম-সহ একাধিক প্রতিবাদী গ্রেফতার হয়েছেন।
তারই প্রতিবাদে এ দিন বাগবাজারে দিনভর প্রতিবাদী জমায়েত করলেন ‘লাদাখের বন্ধু’ পরিবেশকর্মীরা। সকাল ৬টা থেকে ১২ ঘণ্টার প্রতীকী অনশনেও বসলেন তাঁরা। ওই সংগঠনের তরফে সুরজিৎ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সাংবিধানিক অধিকার। তার দাবিতেই সোনমজী এত দিন আন্দোলন করেছেন। বৃষ্টিচ্ছায় লাদাখকে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে বাসযোগ্য করেছেন। অথচ পুঁজিবাদীদের অতিমুনাফার স্বার্থে দেশসেবক সোনমকেই ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে আজ যোধপুরের জেলে বন্দি রাখা হয়েছে। আগামী প্রজন্মের স্বার্থে পরিবেশরক্ষার এই আন্দোলন যাতে বজায় থাকে এবং সোনমজীকে দ্রুত মুক্তির দাবিতেই পথে নেমেছি।’’
সোনমের এই লড়াইয়ে কী পাশে আছে শহর কলকাতা? সংগঠনের তরফে কাকলি চট্টরাজ বলছেন, ‘‘সকাল থেকে অনেকেই উৎসাহ নিয়ে মঞ্চে লেখা পোস্টার পড়েছেন, লিফলেট নিয়েছেন। আশা করছি, সারা দিনে অনেকের মনেই পরিবেশ এবং সোনমজীকে নিয়ে আগ্রহ জাগাতে পারব। গোটা দেশে মানুষ প্রতিবাদী হলে ফল মিলবেই। কারণ, উন্নয়নের নামে পরিবেশের এই ধ্বংসলীলা শুধু লাদাখে নয়, গোটা দেশেই চলছে।’’
কথা বলতে বলতেই মঞ্চে হাজির যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্রী, এই সংগঠনের সদস্য রিম্পা দানা। আগের রাত থেকেই কোনও কিছু দাঁতে কাটেননি রিম্পা। এর মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চাইছেন? রিম্পার কথায়, ‘‘ভারতের কোনও এক কোণে এক জন মানুষ জেল খাটছেন, নিজের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছেন— যাতে আপনি ও আপনার সন্তান আগামী দিনে ভাল থাকেন। তাই এটা শুধু লাদাখের নয়, এটা আমার-আপনার আন্দোলনও বটে।’’