• সিনেমা দেখতে বসে সপাটে চড় খেতে কার ভাল লাগে? ঋত্বিক ঘটকের সব ছবি পছন্দ নয় পরমব্রতের!
    আনন্দবাজার | ১০ নভেম্বর ২০২৫
  • ‘ভাল লাগে না’, বলা খুব সোজা। অমুকের ছবি ভাল লাগে না। তমুকের অভিনয় নাপসন্দ। ঋত্বিক ঘটকের সব ছবি ভাল লাগে না, বলাও কি ততটাই সহজ? সিনেবোদ্ধারা হয়তো বলবেন, এ রকম ভাবতে বা বলতে স্পর্ধার প্রয়োজন। সেটাই দেখালেন প্রয়াত পরিচালকের বংশজাত পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

    ঋত্বিক ঘটকের অনেক ছবিই তাঁর ভাল লাগে না কেন? জবাবে আনন্দবাজার ডট কম-এর কাছে পরমব্রতর সাফ দাবি, “এত অন্য রকম ভাবে গল্প বলা যায়, ছবি চলা বা হাততালি পাওয়া ছাড়াও পরিচালকদের আরও অনেক বড় কাজ থাকে, সেই সত্যির পাঁচন গিলতে কি কারও ভাল লাগে?” প্রয়াত পরিচালকের সিনেমা দেখতে বসে সপাটে চড় খেতে রাজি নন তিনি। এ বছর ঋত্বিকের জন্মশতবর্ষ। এপিজে বাংলা সাহিত্য উৎসব তাঁকে স্মরণ করেছে আলোচনার মাধ্যমে। সেই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন এই প্রজন্মের প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা।

    পরমব্রতর দাবি, ঋত্বিক ঘটকের সব ছবি ভাল না লাগার আরও একটি কারণ, তাঁর ভাল লাগার চোখ একভাবে তৈরি হয়েছে। দর্শক ছায়াছবিতে ‘ড্রামা’ দেখতে পছন্দ করেন। তিনিও সে ভাবেই তৈরি। তিনিও ছোটবেলা থেকে হলিউড দেখে, গল্প দেখে বড় হয়েছেন। পরমব্রতর কথায়, “আমরা অধিকাংশ সময়েই তাই পর্দায় গল্প বলি। কিন্তু সিনেমার কি আদৌ গল্প বলা কাজ?”

    ঋত্বিকের ছবি বুঝতে শিখিয়েছে, সিনেমা গল্প বলতে পারে। কিন্তু গল্প বলাই সিনেমার একমাত্র কাজ নয়। পাশাপাশি এ-ও স্বীকার করেছেন, তিনি ছবিতে শুধুমাত্র গল্পই বলতে পারেন। ঋত্বিক ঘটক কখনও ‘ড্রামা’ নাটক বা ‘গল্প বলা’য় প্রবেশ করেননি। সাধারণের মন যে ভাবনায় চালিত, সেই দিক ধরে ধরে দেখিয়েছেন। ওঁর উদ্দেশ্য, ছবির মাধ্যমে চপেটাঘাত করে বোঝানো, কী ভাবে মানব সভ্যতার ইতিহাস, ছবির ইতিহাসকে ধ্বংস করা হয়েছে। পরিচালকের এই ভাবনা অবশ্য ৯০ শতাংশ দর্শকেরই বোধগম্য নয়। প্রয়াত পরিচালক তবু তাঁর মতো করে চেষ্টা করেছেন। গল্প বলায় সীমাবদ্ধ না থেকে, ‘ড্রামা’য় নিজের ছবিকে আটকে না রেখে, তিনি ইতিহাসকে দুমড়ে মুচড়ে অন্য ভাবে বলেছেন, দেখিয়েছেন।

    ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে আলোচনায় সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ আসবেই। তার কারণও আছে। বাঙালির বিনোদনের ইতিহাস এখনও পর্যন্ত এই দুই মহীরুহের ছত্রছায়াতেই যেন লালিত। এ দিন তিনি সেই দিকও বিশ্লেষণ করেন। পরমব্রতর কথায়, “সমস্ত পরিচালককে সম্মান জানিয়ে বাংলা ছবির ইতিহাসের দুই মহীরুহ হিসাবে যদি সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটককে ধরি, তা হলেই দেখা যাবে, কী ভাবে আমরা তাঁদের মেরুকরণ করি। বিপরীত মেরুর দুই ব্যক্তিত্ব। আমরা দুই মেরুর প্রতিই সমান আসক্ত।” প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা উপলব্ধি করেছেন, সত্যজিৎ যেন সাধু-সন্ত, ব্রহ্মপুরুষ! তাঁর কোনও ভুল হতে পারে না। তাঁর কাজ নিয়ে তাই যেন কাটাছেঁড়াও হতে পারে না। তিনি দর্শকের কাছে যুগপুরুষ। এর ঠিক বিপরীত ঋত্বিক ঘটক। বাঙালির কাছে তাঁর পরিচিতি কী? “কাঁধে একটা ঝোলা আছে। সেখান থেকে বাংলা মদের বোতল উঁকি মারছে। একটা খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা, পানাসক্ত ব্যক্তি প্রচুর জ্ঞানগর্ভ বাণী দিচ্ছেন। সমানতালে মজাও করছেন।” পরমব্রতের দাবি, সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিতে তাঁর মতো করে সমসাময়িক সমাজ, নারীচরিত্র ধরেছেন— এটা যেমন সত্যি, তেমনই ঋত্বিক ঘটক মানেই শুধু অপচয়ে ফুরিয়ে যাওয়া এক কালজয়ী প্রতিভা নন।

    বিদ্যায়, বোধে, মেধায়, পাণ্ডিত্যে, বুদ্ধিতে— কারও থেকে কোনও অংশে কম ছিলেন না শতবর্ষ পূর্ণ হওয়া প্রয়াত পরিচালক। অন্য রকম করে ভাবতে পারতেন বলেই তাঁর ছবি বাকিদের থেকে আলাদা। সেটা ক্যামেরার ফ্রেম হতে পারে। ঘটনা তুলে ধরার ভঙ্গি হতে পারে। মায়ের মৃত্যুদৃশ্যে কর্কশ শব্দ তুলে ট্রেনের চলে যাওয়া হতে পারে।

    আগামী দিনে পরমব্রত কি সার্থক উত্তরসূরি হিসাবে সচেতন ভাবে ঋত্বিক ঘটকের ঘরানায় ছবি বানাবেন?

    এই প্রশ্নের জবাবেও অকপট তিনি। স্পষ্ট বলেছেন, “আমি কখনওই ঋত্বিক ঘটকের মতো ছবি বানাতে পারব না। বানাতে চাইবও না। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে ধরনের ছবি চলে বা তৈরি হয়, সেটাই বানাব আমি।”
  • Link to this news (আনন্দবাজার)