যে দ্রুততায় এসআইআর শুরু হয়েছে বাংলায়, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এ বার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হল তৃণমূলও। তামিলনাড়ুর শাসকদল ডিএমকে ইতিমধ্যে এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলে শীর্ষ আদালতে মামলা করেছে। সোমবার তৃণমূলের হয়ে পিটিশন ফাইল করলেন রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেন এবং দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মালা রায়। মঙ্গলবারই বিচারপতি সূর্যকান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চে এই মামলার শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য, বিহারে এসআইআর শুরুর সময়ে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রও সাংসদ হিসাবে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চান, চলতি প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ হওয়া উচিত। তবে শিলিগুড়ি থেকে তিনি প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, এসআইআর-এর নথিপত্র সংক্রান্ত কাজে সাধারণ মানুষকে যেন নিরপেক্ষতা নিয়ে সাহায্য চালিয়ে যাওয়া হয়।
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) কাজ নিয়ে রাজ্যবাসীর একাংশের মনে আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এসআইআর-এর ‘আতঙ্কে’ মৃত্যু এবং আত্মহত্যার মতো অভিযোগও উঠে এসেছে। এ অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত, এত তাড়াহুড়ো করে এসআইআর সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। তবে একই সঙ্গে রাজ্যবাসীকে নিজেদের মতো করে এনুমারেশন ফর্ম পূরণেরও পরামর্শ দেন মমতা।
বন্যা-বিপর্যয় পরবর্তী উত্তরবঙ্গের প্রশাসনিক কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে সোমবার আবার শিলিগুড়িতে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যসচিব মনোজ পন্থও গিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। বিকেলে উত্তরকন্যা থেকে সাংবাদিক বৈঠকে প্রশাসনিক আধিকারিকদের মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন, এসআইআর-এর কাজে রাজ্যবাসীকে সাহায্য করতে হবে। কেউ যাতে আত্মহত্যার পথ বেছে না-নেন, সেই বার্তাও দেন মুখ্যমন্ত্রী।
উত্তরবঙ্গের বন্যাবিধ্বস্ত এলাকার মানুষদের সমস্যা দূর না-হওয়া পর্যন্ত ‘কমিউনিটি কিচেন’ চালু রাখার কথা বলেন মমতা। ওই সময়েই পঞ্চায়েত, পূর্ত, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আধিকারিক থেকে শুরু করে জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা পরিষদ এবং পুরসভাগুলিকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন তিনি। আধিকারিকদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মানুষের পাশে থাকবেন। সব ব্যাপারে সাহায্য করবেন। নিরপেক্ষ ভাবে সকলকে এসআইআর করতেও সাহায্য করবেন।”
বন্যার জলে যাঁদের নথিপত্র হারিয়ে গিয়েছে, তাঁদেরও উদ্বিগ্ন না-হওয়ার অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকারের ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির আওতায় তাঁদের নথিপত্র পুনরায় করিয়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। আধিকারিকদের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কাউকে যেন আত্মহননের পথ বেছে নিতে না-হয়। তাঁরা সকলেই আমাদের দেশের নাগরিক। জেনুইন (প্রকৃত) নাগরিকেরা যেন বঞ্চিত না-হন। চিন্তা করবেন না, হতাশ হবেন না। মনে জোর রাখুন।”
এসআইআর নিয়ে রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করার সময়ে রাজবংশী, মতুয়া, কামতাপুরী-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করেন মমতা। বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, তাঁর সরকার প্রত্যেক রাজ্যবাসীর পাশে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেন, “সবাই নিজের মতো এসআইআর-টা করুন। যে ভাবছেন তাঁর কাছে কিছু (নথি) নেই, আপনি তো পাঁচ কেজি রেশন পান। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডও আছে, লক্ষ্মীর ভান্ডার আছে, সেগুলি নিয়ে বলুন। ওরা ঠিক আপনাদের (নথি) বার করে দেবেন। চিন্তা করবেন না। অনেক হেল্প ক্যাম্প আছে, সেখানে কথা বলুন। বিএলও এবং বিএলএ-দের সঙ্গেও কথা বলুন।” জেলাশাসক এবং ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকদের এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার পরামর্শও দেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের এসআইআর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে তামিলনাড়ুর শাসকদল ডিএমকে। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী জানান, তাঁরাও আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এত কম সময়ের মধ্যে এসআইআর হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে ফের এক বার বাংলাভাষী মানুষদের উপর অত্যাচারের অভিযোগে বিজেপি-কে নিশানা করেন মমতা। নাম না-করে বিজেপিকে বিঁধে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বাংলা ভাষায় কথা বললে এত অত্যাচার কেন! কেন তোমাদের জন্য এত মৃত্যু হবে? লজ্জা করে না! এত মানুষের প্রাণ কাড়ছ!”
মোদী সরকারের জমানায় অতীতে ‘নোটবন্দি’-র সিদ্ধান্তের জেরে সাধারণ মানুষকে প্রচুর সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল। দৈনন্দিন কাজকর্ম ছেড়ে বহু মানুষকে ব্যাঙ্কে, এটিএমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এ বার সেই ‘নোটবন্দি’র সঙ্গেও এসআইআর প্রক্রিয়ার তুলনা টানলেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার কথায়, এসআইআর হচ্ছে ‘ভোটবন্দি’। তিনি বলেন, “আপনাকে প্রমাণ করতে হবে— আপনি আপনাকে চেনেন, আপনি এ দেশের নাগরিক। এর চেয়ে বড় অসম্মান… কেন? (এসআইআর) করার জন্য দু’বছর সময় নিতে পারত। ভাল করে সার্ভে করতে পারত। জনগণনা করতে পারত। হঠাৎ ভোটের আগে এত কিসের তাড়াহুড়ো, এত কিসের জলদিবাজি।”
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, দু’মাসের মধ্যে এসআইআর সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। গায়ের জোরে বিজেপির কথামতো এটি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর। দু’বছর সময় নিয়ে এই প্রক্রিয়া করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়, তা হলে তার মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাম লেখাতে হবে। অনেকে নাম লেখাতে পারবেন না। অনেকের নাম ড্রাফ্ট লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া হবে। তাঁরা আবার ফিলআপ করতে যাবেন। সেখান থেকে আবার বাদ দেওয়া হবে। এই তিন মাস সরকার যাতে কাজ করতে না-পারে, তাই ঘুরিয়ে সুপার এমার্জেন্সি করা হয়েছে। অফিসারদের এই কাজে আটকে রাখা হয়েছে।”
বস্তুত, কমিশন নিযুক্ত বিএলও হিসাবে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ স্কুলশিক্ষক। তাঁরা স্কুলের কাজ করার পরে কমিশনের কাজ কী ভাবে করবেন,তা নিয়েও সংশয়ী মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর প্রশ্ন, দিনে দু’ঘণ্টা করে যদি কাজ করেন বিএলও-রা, তবে কত জনের বাড়ি যাওয়া সম্ভব! তাই এই প্রক্রিয়ায় এখনও স্থগিতাদেশ আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি এখনও মনে করি, এই প্রক্রিয়ায় স্টে হয়ে যাওয়া উচিত।”
বিজেপি তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে ‘সিএএ অফিস’ চালু করেছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ১৪ জন মানুষ ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন। এর জন্য বিজেপির কোনও দুঃখ নেই বলে অভিযোগ তোলেন মমতা। বিজেপি ‘ধর্মের নামে কার্ড বিক্রি’ করছে বলেও দাবি মুখ্যমন্ত্রীর। কমিশন যে এনুমারেশন ফর্ম বিলি করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে তাঁর। যে ফর্মটি কমিশন তৈরি করেছে, তা সব দরিদ্র মানুষ বুঝতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দিহান মমতা।