দুধের দামে ‘নভেম্বর বিপ্লব’! লিটারে ৪ টাকা পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি বাংলার ডেয়ারির দুধের, কারণ কী? ব্যাখ্যা দিলেন মন্ত্রী
আনন্দবাজার | ১০ নভেম্বর ২০২৫
ধাপে ধাপে বাড়ছিলই। কখনও প্রতি লিটারে ১ টাকা। কখনও আবার ২ টাকা। কিন্তু নভেম্বরের গোড়ায় বাংলার ডেয়ারির দুধের মূল্যবৃদ্ধি কার্যত বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। নির্দিষ্ট একটি ব্র্যান্ডের দুধের দাম এক লাফে লিটারপ্রতি বেড়ে গিয়েছে ৪ টাকা!
বাংলার ডেয়ারির সবচেয়ে ভাল মানের দুধের ব্র্যান্ডের নাম ‘সুপ্রিম’। অক্টোবরে সেই দুধের লিটারপ্রতি দাম ছিল ৫৬ টাকা। এক লাফে নভেম্বরের গোড়ায় সেটা হয়ে গিয়েছে ৬০টাকা। অন্যান্য ব্র্যান্ডেরও দাম বেড়েছে। যেমন ‘তৃপ্তি’র লিটারপ্রতি দাম ছিল ৫২ টাকা। তা বেড়ে হয়েছে ৫৪ টাকা। আবার ‘স্বাস্থ্যসাথী ডবল টোন’ দুধের দাম ছিল ৪৬ টাকা লিটার। সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ টাকা লিটার। বছর দেড়েক আগে যখন বাংলার ডেয়ারি ‘সুপ্রিম’ ব্র্যান্ডটিকে বাজারে এনেছিল, তখন লিটারপ্রতি তার দাম ছিল ৫০ টাকা। অর্থাৎ, দেড় বছরের মধ্যে সেই দাম লিটারে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবনে এবং চায়ের ছোটখাটো দোকানদারদের উপর। এ-ও ঠিক যে, শুধু এই সংস্থার নয়। অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার দুধের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে এই সময়ে। তবে সরকারি সংস্থার দুধের দামের বৃদ্ধির হার চোখে পড়ার মতো। দক্ষিণবঙ্গে বাংলার ডেয়ারির একাধিক সরবরাহকারীর বক্তব্য, সাম্প্রতিক অতীতে কখনওই কোনও ব্র্যান্ডে লিটারে এক ধাক্কায় ৪ টাকা দাম বাড়েনি। হাওড়ার বামুনগাছি এলাকার বাসিন্দা রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী বিমল মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘মাদার ডেয়ারির সময় থেকে ধরলে গত ৩৫ বছর ধরে এই সংস্থার দুধ প্রতি দিন কিনি। কিন্তু এমন একলাফে দাম বাড়তে কখনও দেখিনি।’’ হুগলির বৈদ্যবাটির ছোট একটি চা দোকানের কারবারি সঞ্জয় ঘোষের বক্তব্য, ‘‘বাংলার ডেয়ারির সুপ্রিমের গুণমান নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। সত্যিই এক নম্বর দুধ। আমি আমার দোকানে এই দুধেরই চা তৈরি করি। কিন্তু লিটারে ৪ টাকা দামবৃদ্ধি কবে কোন সংস্থার দুধের হয়েছে আমি মনে করতে পারছি না।’’
প্রতি বছর দুধের চাহিদা বাড়ছে। রাজ্য সরকারের প্রাণীসম্পদ দফতর সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গে দুগ্ধ উৎপাদনের বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ৯.৭ শতাংশ। কিন্তু এতটা দাম বাড়ল কেন? প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের ব্যাখ্যা, ‘‘এই বছর অতিবৃষ্টির কারণে সবুজ ঘাস ও অন্যান্য গোখাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। এর ফলে দুধের উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে এবং কাঁচামালের দামও এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়েছে।’’
মন্ত্রীর আরও ব্যাখ্যা, ‘‘দুগ্ধ উৎপাদকদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে বাংলার ডেয়ারি বিগত দু’বছর সর্বাধিক মূল্যে তাঁদের কাছ থেকে দুধ ক্রয় করে এসেছে। কাঁচামালের বর্ধিত দামের প্রভাব কাটিয়ে ব্যবসার অর্থনৈতিক সাম্য বজায় রাখতে (নো প্রফিট নো লস্) বাংলার ডেয়ারির দুধের বিক্রয়মূল্য কিছুটা বাড়াতে হয়েছে।’’ পাশাপাশিই তাঁর এ-ও যুক্তি যে, দাম বৃদ্ধির পরেও অন্যান্য সংস্থার দুধের থেকে বাংলার ডেয়ারির দুধের বিক্রয়মূল্য লিটারপিছু ৪ টাকা থেকে ৬ টাকা কম রাখা হয়েছে সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে। দুধের দাম বাড়লেও সম্প্রতি ঘি, আইসক্রিম, পনির ইত্যাদি দুগ্ধজাত পণ্যের দাম তেমন বৃদ্ধি করেনি বাংলার ডেয়ারি। দুধের দামবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের নিন্দা করে রাজ্য বিজেপি সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন, ‘‘সরকারের অজুহাত—বৃষ্টি হয়েছে, খরচ বেড়েছে। তা হলে প্রশ্ন—পাঁচ বছরে কৃষি–পশুপালনে পরিকল্পনা কোথায়?’’
বছর পাঁচেক আগে মাদার ডেয়ারির নাম বদলে করা হয়েছিল ‘বাংলার ডেয়ারি’। ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (এনডিডিবি) হাত থেকে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসার পরেও নাম ছিল মাদার ডেয়ারি। ২০২০ সালে সেই নামের বদল করে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছানুসারে মাদার ডেয়ারির নতুন নাম হয় ‘বাংলার ডেয়ারি’। এর মাঝে বাংলার ডেয়ারির শেয়ার বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ অধীর চৌধুরী। তিনি আদালতে মামলাও করেছিলেন। তবে আদালত তেমন কিছু খুঁজে পায়নি। চাহিদার বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে উৎপাদন বৃদ্ধিতেও জোর দিয়েছে বাংলার ডেয়ারি। হরিণঘাটায় তৈরি হয়েছে পৃথক ইউনিট। নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের মাটিগাড়াতেও। কিন্তু তার পরেও মূ্ল্যবৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে না।