মানুষের জোটই কংগ্রেসের শক্তি, সংবিধানই আমাদের ধর্মগ্রন্থ: শুভঙ্কর সরকার
দৈনিক স্টেটসম্যান | ১১ নভেম্বর ২০২৫
বছর ঘুরলেই রাজ্যে ভোট। তার তাতেই চড়ছে রাজনীতির পারদ। ভোটের আগে বাংলায় শুরু হয়ে গিয়েছে এসআইআর। ফেব্রুয়ারির মাসের ৭ তারিখ এসআইআর প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা। তারপরই বিধানসভা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়ে যাবে বলে মত রাজনীতি মহলের একাংশের। আর তার আগে দৈনিক স্টেটসম্যানের কাছে মুখ খুললেন প্রদেশ কংগ্রস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। প্রদেশ কংগ্রসের সভাপতি হয়েছেন এক বছর হল। এই এক বছরের অভিজ্ঞতা, বর্তমানে চলা এসআইআর প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন শুভঙ্কর সরকার। এছাড়া রাহুল গান্ধীর অবস্থান এবং বাংলায় কংগ্রেসের ভবিষৎ নিয়ে নিজের মত জানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রসে সভাপতি।
প্র: এক বছরে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন?
উ: বর্তমানে রাজনীতি করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয়। অতীতে রাজনৈতিক কর্মীরা মানুষের কাছে যে সম্মান পেতেন, বর্তমানে তা পান না। কংগ্রেস মানুষের কথা বলে, মানুষের জন্য লড়ে, মানুষের জোট গড়ে তোলে। তাই সামনে যতই কঠিন লড়াই হোক না কেন, আমরা মানুষের আশীর্বাদ নিয়েই লড়ব।
প্র: দোরগোড়ায় বিধানসভা নির্বাচন। মানুষ কেন কংগ্রেসকে বেছে নেবেন বলে মনে হয়? কোনও বিশেষ কাজের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন?
উ: বর্তমানে বাংলায় যে অরাজকতা চলছে তা থামানোই আমাদের বড় লক্ষ্য। বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষির উন্নতি এই তিনটি বিষয়ের উপরই আমরা জোর দিচ্ছি। স্বাস্থ্য ছাড়া শিক্ষা অসম্ভব আর কৃষি ছাড়া দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই মানুষের সার্বিক উন্নয়নই কংগ্রেসের লক্ষ্য। এই তিনটি বিষয়কে ভিত্তি করেই আমরা আগামীতে মানুষের কাছে পৌঁছতে চাই।
প্র: এসআইআর আগেও হয়েছে, তবে এবার এত বিতর্ক কেন? এই বিষয় প্রদেশ কংগ্রেসের অবস্থান কী?
উ: এসআইআর এর কাজ হল মৃত ভোটার, ভুয়ো ভোটার এবং অবৈধ ভোটারের নাম বাদ দেওয়া। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কোন কাজের স্থায়িত্ব আসে না। সত্যিকারের নাগরিক না কি নাগরিক নয়, সেই বিচার করলে তা সময় নিয়ে করা উচিত। আমরা এসআইআর প্রকল্পের বিরোধী নই, তবে এর প্রয়োগ ও প্রক্রিয়াগত ত্রুটিগুলির সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি। ১৯৫২ সালে ‘বিউটি অফ ডেমোক্রেসি’ তৈরি করেছিল কংগ্রেস। হেড মাস্টার থেকে বিচারপতি, গৃহ পরিচালিকা সবাই এক সঙ্গে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেবেন। এটাই গণতন্ত্র। আর এই সৌন্দর্যকে এরা নষ্ট করে দিচ্ছে।
প্র: এই ত্রুটিগুলো কী, সেগুলো যদি মানুষের সুবিধার্থে বিস্তারিত বলেন?
উ: নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সংস্থা। বর্তমানে সেটি বিজেপির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। ভারতের নির্বাচন কমিশন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে ব্রাজিলিয়ান মডেল এসে ভারতে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। কংগ্রেসের কাছে মনুবাদ নয় সংবিধানই দেশের ধর্মগ্রন্থ। আমরা সংবিধানকে সামনে রেখে মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে লড়ছি, আগামীতে লড়ব এবং মানুষের কথা বলব।
প্র: ব্রাজিলিয়ান মডেল তাঁর সমাজমাধ্যমে জানিয়েছেন তিনি কখনও ভারতে আসেননি। কখনও ভারতে ভোট দেননি। ভারতের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। এই প্রসঙ্গে আপনি কি বলবেন?
উ – এই ঘটনায় ভারতবর্ষের সম্মান বাড়লো না কমলো? একজন বিদেশী মানুষের ভারতবর্ষের রাজনীতি সম্পর্কে কী ধারণা তৈরি হল? ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস হেরে যায়। ২০২৪ এর ভোটেও কংগ্রেস পরাজিত হয়। এমনকী হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনেও কংগ্রেসের হার হয়। এরপর রাহুল গান্ধী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধান দল গড়ে কাজ করেন। তাতেই ধরা পড়ল, ভোট চোর অন্য কেউ নয়। স্বয়ং নির্বাচন কমিশন ভোট চুরি করেছে। এরপর রাহুল গান্ধী গোটা বিষয়টি সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরলেন। রাহুল গান্ধীর সেই সাংবাদিক সম্মেলন ছিল ঐতিহাসিক। যে কাজটা করা উচিত ছিল সংবাদ মাধ্যমের তা রাহুল গান্ধী করে দেখালেন।
প্র: ভোট চুরির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে না কেন?
উ: প্রশ্নটা উল্টোও হতে পারে। রাহুল গান্ধীর অভিযোগ যদি মিথ্যে হয়, তবে নির্বাচন কমিশন কেন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করছে না? বিজেপির নেতারা কেন কমিশনের হয়ে উত্তর দিচ্ছেন। সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করলেই সত্য প্রকাশিত হয়ে যায়। স্বচ্ছতা নষ্ট করেছেন জ্ঞানেশ কুমার ও নির্বাচন কমিশন নিজেই। পোলিং স্টেশনের ভিতরে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সেই সিসিটিভি ফুটেজ মানুষের সামনে আনা হচ্ছে না কেন? তাহলেই তো পরিষ্কার হয়ে যাবে, সুইটি-বিউটি-সরস্বতী নামে কেউ ভোট দিতে গিয়েছিলেন নাকি কম্পিউটারের মাধ্যমে তা অপারেট করা হয়েছিল।
প্র: তাহলে জ্ঞানেশ কুমারকে নিয়ে কংগ্রেসের অবস্থান কী?
উ: উনি থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। রাহুল গান্ধীর ভাষায় বলি— জ্ঞানেশ কুমার দেশ ছাড়লেও সংবিধান তাঁর পিছু নেবে।
প্র: বাংলায় এসআইআর নিয়ে গণস্বাক্ষর অভিযানের ফল কতটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?
উ: নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে, এটা মানুষ বুঝতে পেরেছে। এখন কমিশন গঠিত হচ্ছে ‘টু ইস্টু ওয়ান’ পদ্ধতিতে— প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের প্রতিনিধিরা মিলে। প্রধান বিচারপতির জায়গায় যখন রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের বসানো হয়, তখনই বোঝা যায় গণতন্ত্রের ভারসাম্য কোথায় যাচ্ছে। পুলিশ যদি অন্যায় করে, তাহলে মানুষ ন্যায় চাইবে কোথায়? আজ সেই প্রশ্নই আমাদের সামনে।
প্র: ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একলা লড়বে না জোটে? এর আগে জোট বা আসন সমঝোতা কোনোটাতেই কংগ্রেসের খুব একটা লাভ হয়নি। তাহলে এবার কংগ্রেসের নীতি কী হবে?
উ: জোট বাধো তৈরি হও, বাংলার উন্নতি ঘটাও। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। যখন বিজেপির মতো বুর্জয়া পার্টি, বর্বর পার্টি আক্রমণ করে তখন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। সেই ডাকটা হচ্ছে মানুষের, কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। গান্ধীজী তো সেই পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। ডাণ্ডি অভিযানে তিনি প্রথমে একা হেঁটেছিলেন। তারপরে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
প্র: কংগ্রেসের কামব্যাকের রূপরেখা কী?
উ: মানুষের মধ্যে নতুন করে বিশ্বাস জাগানোই আমাদের মূল লক্ষ্য। কোনও রাজনৈতিক দল যদি মানুষের স্বার্থে রাস্তায় থাকে তাহলে মানুষও সেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাস্তায় থাকবে। আমার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হল সমস্ত কংগ্রেস কর্মীদের একসঙ্গে একত্রিত করা এবং তাঁরা কী বলতে চায় সেটা শোনা। বাংলার মানুষকে কীভাবে কংগ্রেসের পক্ষে আনা যায় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা। কংগ্রেস ছাড়া বাংলার উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই কংগ্রেসকে আবার ক্ষমতায় আসতেই হবে। আমাদের মূল লক্ষ্য মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা। মানুষের কথা তুলে ধরা।
প্র: শুভঙ্করবাবু মানুষ আপনাদের উপর সেই বিশ্বাসটা রাখবে কেন? বাইরণ বিশ্বাসকে তো ধরে রাখতে পারলেন না, বেরিয়ে গেল?
উ: বাইরন কংগ্রেসকে তৈরি করেননি, কংগ্রেস বাইরনকে তৈরি করেছিল। কেউ চলে গেলে কংগ্রেস থেমে যায় না। মানুষের জন্য, মানুষের স্বার্থে কংগ্রেস আগেও ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।