আজও ভোটার নন! প্রশ্নের মুখে স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের সদস্যের ‘নাগরিকত্ব’
প্রতিদিন | ১১ নভেম্বর ২০২৫
টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: যারা দেশ স্বাধীন করল, তাদের পরিবারেই সংশয়! নামই নেই ভোটার তালিকায়। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরও এসআইআর আবহে সামনে এল সেই ছবি। বিপ্লবী ভূপালচন্দ্র বসুর কাকাতো ভাই জীতেন্দ্রনাথ বসুর মেয়ে, আর ঋষি অরবিন্দ ঘোষের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর ভাইঝি, কল্পনা বসু আজও ভোটার নন। বাঁকুড়ার বিকনা ক্ষীরোদপ্রসাদ বৃদ্ধাশ্রমের এক ছোট্ট ঘরে বসে ৭৯ বছরের এই মহিলার এখন একটাই প্রশ্ন, “দেশের জন্য জেল খেটেছি, তবু আজ ভোটার নই কেন?”
১৯৪৬ সালের ২ জুলাই, কলকাতার শ্যামবাজারের দেশবন্ধু পার্কের পাশে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ বিদ্যাসাগর হাসপাতালে জন্ম কল্পনা বসুর। দেশ তখন স্বাধীনতার ঠিক আগে উত্তাল। ছোটবেলায় ঘরে ঘরে আলোচনায় শুনে এসেছেন, “দেশ মানে ত্যাগ, দেশ মানে সংগ্রাম।” কলেজে পড়ার সময় ব্যালট পেপারে প্রথম ভোট দেন কল্পনা। এরপর ১৯৭০ সালে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেফতার হতে হয় কল্পনাদেবীকে। প্রথমে প্রেসিডেন্সি, পরে বিহারের কারাগারে দীর্ঘ কয়েক বছর বন্দি জীবন কাটাতে হয় তাঁকে।
কিন্তু আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও নিজের নাগরিকত্বের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন! যদিও বয়সের ভারে আজ তিনি ক্লান্ত। কাঁপা গলাতেই কল্পনা বসু জানান, “আমার নাম খুঁজে পাচ্ছি না ভোটার তালিকায়। এই বয়সে কোথায় যাব, কাকে প্রমাণ দেব আমি বেঁচে আছি?” রাজ্যজুড়ে চলছে ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ অর্থাৎ এসআইআর প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়ায় নাম যাচাই, ঠিকানা সংশোধন, নতুন ভোটার সংযোজন-সহ একাধিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত প্রশাসন। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রত্যেক ভোটারের নথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ!
বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক সুরজিৎ কুম্ভকার বলেন, “কল্পনাদেবীর কোনও বৈধ কাগজ নেই। জন্মসনদ, পুরনো ভোটার কার্ড, ঠিকানার প্রমাণ সব হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে। আমরা চেষ্টা করেছি তাঁর নাম এসআইআরে অন্তর্ভুক্ত করতে, কিন্তু প্রমাণ না থাকায় কর্মকর্তারা অসহায়।” তিনি আরও বলেন, “প্রক্রিয়াটা যতই ‘নিবিড়’ হোক, তাতে কল্পনা দেবীর মতো মানুষদের জন্য কোনও পথ খোলা নেই। প্রযুক্তির যুগে সব কিছু তথ্যনির্ভর, অথচ একসময়ের ইতিহাস-নির্মাতা মানুষের নাম আজ ডাটাবেসে নেই।”
কল্পনা বসুর পরিস্থিতির কথা শুনে আতঙ্কিত বৃদ্ধাশ্রমের আরেক আবাসিক নারায়ণ চন্দ্র গরাই। ছাতনার ঝাটিপাহাড়ির বাসিন্দা, রাজ্যের কো-অপারেটিভ অডিট দফতরের প্রাক্তন সহকারী পরিচালক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নারায়ণবাবু বলেন, “২০০২ সালে অসুস্থতার কারণে এসআইআরে অংশ নিতে পারিনি। পরে ২০০৭ সালে নাম তুলেছিলাম, ২০১০ সালে ভোটও দিয়েছি। এ বছর ফের এসআইআর হচ্ছে, তাই নাম আছে কি না জানতে অনলাইনে খুঁজতে হয়েছে। ভাগ্যিস মায়ের নাম এখনও ঝাটিপাহাড়ির ভোটার তালিকায় আছে, না হলে আমারও কল্পনা দেবীর মতো পরিণতি হত।”
বিকেলের আলো পড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায়। কল্পনা বসু চুপচাপ জানলার পাশে বসে আছেন, চোখে যেন হারিয়ে যাওয়া নামের খোঁজ। তাঁর চোখমুখে শুধুই চিন্তার ছাপ, আর একটাই প্রশ্ন, “আমাদের রক্তে স্বাধীনতা, অথচ আমি স্বাধীন নই।”