• কমিশনের ‘আজগুবি’ নির্দেশ, ময়দানে নেমে কাজ করতে গিয়ে চরম বিপাকে BLO-রা!
    প্রতিদিন | ১১ নভেম্বর ২০২৫
  • কৃষ্ণকুমার দাস: ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন অর্থাৎ এসআইআর প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের মৌখিক নানা ‘আজগুবি’ নির্দেশে চরম বিপাকে বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএলও-রা। একদিকে কোটি কোটি ভোটারের তালিকায় নাম তোলা নিয়ে অজস্র সমস্যা ও কৌতূহলঘেরা প্রশ্নবাণ, অন্যদিকে বিজেপি-বামেদের কমিশনে করা নানা অনৈতিক এবং মিথ্যা অভিযোগের চাপে জেরবার বুথের ভোটকর্মীরা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো বড় সংকট হল, আধুনিক প্রযুক্তির সফটওয়‍্যার ও অ্যাপ ব্যবহার করে কাজ করতে গিয়ে নেটওয়ার্ক-পোর্টাল বিভ্রাটের জেরে গলদঘর্ম হচ্ছেন গ্রাম থেকে শহরের বসতি-বহুতলে কর্মরত বিএলও-রা। এর মধ্যে একটা বড় অংশ আবার প্রবীণ এবং এই প্রথমবার বিএলও-র কাজ করতে গিয়ে স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। এখানেই শেষ নয়, পারিবারিক নানা সমস্যায় যাঁরা কিছুদিন আগে ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন, তাঁদের ফর্ম না দিতে যে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে কমিশন তার ধাক্কায় বহু জায়গায় বৈধ ভোটারদের বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন বিএলওরা।

    বস্তুত এই কারণেই রাজ্যের ৮০ হাজার বিএলও-র একটা বড় অংশই শারীরিক ও মানসিক উভয়মুখী চাপে নাভিশ্বাস উঠছে। মাত্র দু’মাসে দু’বছরের কাজ সম্পূর্ণ করার যে টার্গেট কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বিএলওদের উপর চাপানো হয়েছে, তাতে গত সাতদিনে একজনের মৃত্যুর পাশাপাশি অনেক বিএলও-ই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিএলওদের এমন ‘দুর্ভোগ ও সমস্যা’ উপলব্ধি করে আগেই তৃণমূল কংগ্রেস এসআইআর দু’বছর সময় ধার্য করার দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে।

    রাজ্যের প্রায় ৮০ হাজার বুথে এসআইআর প্রক্রিয়ায় কর্মরত বিএলওদের তরফে যে গভীর সমস্যাগুলি নির্বাচন কমিশনের নজরে আনার চেষ্টা হচ্ছে, সেগুলি হল- ১) বিএলওদের অভিযোগ, প্রায় দিনই নির্বাচন কমিশন ঘনঘন এসআইআরের কাজ করার জন্য তৈরি অ্যাপ পরিবর্তন করছে। তাই বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোটারদের কাছে পৌঁছে কিউআর কোড স্ক্যান করে ফর্ম বিলির তথ্য আপলোড করতে গিয়ে দিনভর ভোগান্তি হচ্ছে বিএলওদেরই। ২) নির্বাচন কমিশনের পোর্টালে ভোটার হেল্পলাইন অ্যাপ অধিকাংশ সময় কাজ করছে না। ভোটার সার্ভিস পোর্টালও দিনের অধিকাংশ সময় বিকল থাকছে। অনলাইনে ফর্ম তুলতে গেলে ‘এরর’ শব্দটি স্ক্রিনে ফুটে উঠছে। তাই এপিক কার্ড দিয়ে বিধানসভা-বুথের নম্বর মেলাতে গিয়ে ভোটারদের পাশাপাশি চরম সমস্যায় পড়ছেন বিএলও-রাও।

    ৩) কলকাতার আরবানা বা সাউথ সিটির বহুতল থেকে শুরু করে তিনজলা-তপসিয়া-গোবিন্দপুরের ঘিঞ্জি বস্তিতে মোবাইল নেটওয়ার্কে প্রবল সমস্যা দেখা দেওয়ায় ফর্ম বিলি করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন এই ভোটকর্মীরা। ৪) অধিকাংশ বিএলওই অপরিচিত বুথে কাজ করতে গিয়ে বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। ঘিঞ্জি বস্তিতে একটি ঠিকানায় কয়েকশো পরিবার থাকায় নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে ফর্ম বিলি করলে বিজেপি বা বামেরা ওই বিএলও-র বিরুদ্ধে ‘বাড়ি বাড়ি না যাওয়ার’ মিথ্যা অভিযোগ করছে কমিশনে। তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হল, ঘিঞ্জি বস্তিতে দিনভর মহিলারা অনেকেই ঘরোয়া পোশাকে থাকেন, সেখানে বিএলও ঢুকে ফর্ম বিলি করতে গিয়ে বিব্রত বোধ করছেন।

    ৫) এসআইআর ফর্মের উপরে বিএলও-র নাম ও ফোন নম্বর লিখে দেওয়ায় দিনভর ভোটাররা অজস্রবার ফোন করছেন। নানা কৌতূহল ও আজগুবি প্রশ্ন করে বিএলও-কে নাস্তানাবুদ করছেন। ৬) কোথাও আবার ফর্ম বিলি করতে গেলে প্রবীণ থেকে লেখাপড়া না জানা ব্যক্তিরা টিভির খবরের ভিত্তিতে বিএলও-দের আটকে রাখছেন। তাঁদের যুক্তি, টিভিতে শুনেছি, ‘সরকারি নির্দেশ আছে, আপনাদেরই ফর্ম পূরণ করে দিয়ে যেতে হবে, নাহলে যেতে দেব না’। ৭) একাধিক বুথে ফর্মের তালিকা মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, পাশের বুথ অথবা অন্য ওয়ার্ডে ভোটার তালিকার সঙ্গে মিশে রয়েছে। স্বভাবতই সেই ফর্মগুলি বৈধ ভোটারদের কাছে পৌঁছনোয় প্রবল সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে ‘নট ফাউন্ড’ বলে বিএলও-রা রিপোর্ট দিতে বাধ্য হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আসলে ফর্ম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত বৈধ ভোটাররা। ৮) অনলাইনে ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে যদি কেউ সমস্যায় পড়েন, তখন তাঁকে অফলাইনেও ফর্ম জমা দিতে হবে কিনা, এর কোনও সঠিক উত্তর নেই কমিশনের তরফে। বিএলও-রাও অভিজাত ও প্রবাসে থাকা ভোটারদের পরিবারের কাছ থেকে এমনই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছেন না।

    ৯) বাড়ি নতুন করে তৈরির জন্য অথবা পারিবারিক সমস্যায় কিছুদিন আগে কেউ যদি অন্য ঠিকানায় চলে যান, তবে তাঁদের ফর্ম না দিতে মৌখিকভাবে বিএলওদের নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। স্বভাবতই বৈধ ভোটারদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন বিএলওরা। ১০) বহুতল আবাসন এবং অভিজাত বাড়িতে বিএলওদের ঢুকতে দিচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে ফর্ম দেওয়ার নিদান দিয়েছেন বাসিন্দারা। উল্টোদিকে গ্রামে বহু দূর-দূরান্তে অনেক পরিবার থাকেন, স্বভাবতই পায়ে হেঁটে ফর্মের ভারী ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে নাকাল বিএলওরা। অন্যদিকে, কাজ সম্পূর্ণ করার কমিশনের যে ফতোয়া তা মানতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
  • Link to this news (প্রতিদিন)