• বঙ্কিম তুমি কি পথ হারাইয়াছ? তৃণমূল-সিপিএমে দ্বন্দ্ব পদ্মের অভিযোগ ঘিরে, বন্দেমাতরমের ১৫০ বছরে বেহাল বঙ্কিমনিবাস
    আনন্দবাজার | ১১ নভেম্বর ২০২৫
  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কার? তিনি কি রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে পথ হারাইয়াছেন? তাঁর লেখা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা গভীর জঙ্গলে যে প্রশ্ন নবকুমারকে করেছিল, সে প্রশ্ন এখন তার রচয়িতার দিকেই ধেয়ে আসছে। তা-ও আবার তাঁরই বিরচিত ‘বন্দে মাতরম’ গানের সার্ধশতবর্ষে!

    বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেছেন, ‘বন্দে মাতরম’ গানের সার্ধ শতবর্ষ উদ্‌যাপনে তাঁকে ‘বাধা’ দেওয়া হয়েছে। বিজেপির সেই অভিযোগের জেরে চাপানউতর শুরু হয়েছে তৃণমূল-সিপিএমের মধ্যে। শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। কে কত ‘বঙ্কিমপ্রেমী’!

    কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের একটি বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ জীবন কেটেছিল। ওই বাড়িতেই তাঁর প্রয়াণ হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বাড়িটিকে রাজ্য সরকার গ্রন্থাগারে পরিণত করে। সেই ‘সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগার’-এই শুভেন্দু গত শুক্রবার গিয়েছিলেন ‘বন্দে মাতরম’ রচনার ১৫০ বছর উদ্‌যাপন করতে। কিন্তু বাড়িটির দু’টি প্রবেশপথেই তালা ঝোলানো ছিল। এক বিজেপি কর্মী পাঁচিল টপকে ভিতরে গিয়ে বঙ্কিমের আবক্ষ মূর্তিতে মালা দেন। কিন্তু শুভেন্দু পাঁচিল টপকাতে পারেননি। ফলে তিনি ঢুকতে পারেননি। তবে বিরোধী দলনেতা পাঁচিল টপকে গিয়ে কেনই বা বঙ্কিমের মূর্তিতে মালা দিতে যাবেন!

    রবিবার বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য সেই ‘বাধা’র বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। তাঁর অভিযোগের তির ছিল তৃণমূলের দিকে। শমীক অভিযোগ করেন, শুভেন্দুকে ‘আটকাতে’ বঙ্কিমের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে যাওয়ার রাস্তা তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা পুরসভা খুঁড়ে দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বঙ্কিমের পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের দুই সদস্য সজল চট্টোপাধ্যায় ও সুমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। সজল দাবি করেছিলেন, গত ছ’মাসে যত বার তিনি ওই গ্রন্থাগারে গিয়েছেন, তত বারই সেটি তালাবন্ধ পেয়েছেন। আর সুমিত্রের বক্তব্য ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র যেহেতু সারা ভারতের, সেহেতু প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার ওই বাড়ির দায়িত্ব নিক। কারণ, রাজ্য সরকার বা কলকাতা পুরসভাকে দিয়ে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না।

    শুভেন্দুরা ওই বাড়ি তথা গ্রন্থাগারে গিয়েছিলেন সপ্তাহের শেষ পূর্ণদিবস কাজের দিনে। আনন্দবাজার ডট কম সেখানকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছে সোমবার, অর্থাৎ সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে। তাতে বিজেপির বক্তব্যের সঙ্গে বাড়িটির ছবি অনেকাংশে মিলেছে। গ্রন্থাগারের দু’টি গেটেই তালা। পাঁচিলের গ্রিলে ফুটপাথবাসীদের জামাকাপড় মেলা। বারান্দায় পিস্‌বোর্ডের বিছানার উপরে গুটিয়ে রাখা কাঁথা-কাপড়। গোটা গলি জুড়ে কংক্রিটের রাস্তা খুঁড়ে মেরামতি চলছে। বঙ্কিমনিবাসের পাঁচিলে সেই কাজের বিজ্ঞাপনী ব্যানারও ঝুলছে। তাতে জ্বলজ্বল করছে তৃণমূল কাউন্সিলর সুপর্ণা দত্তের নাম। একই সঙ্গে ঝুলছে বিজেপির একাধিক পতাকাও।

    স্থানীয় তৃণমূল নেতা ভাস্কর সিংহ সোমবার বঙ্কিমনিবাসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘রাস্তা ইচ্ছাকৃত খুঁড়ে দেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য। এই কাজ আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কাউকে বাধা দেওয়ার দরকার হলে তো আমরা গলির মুখটাই আটকে দিতে পারতাম! সে সব দূরে থাক, আমরা একটা পাল্টা স্লোগানও দিইনি।’’ তা হলে শুভেন্দু ওই বাড়িতে ঢুকতে পারলেন না কেন? তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘পুরোটাই সিপিএমের কারণে। এই বাড়িতে যে গ্রন্থাগার চলছে, তার পরিচালন সমিতি শুরু থেকেই সিপিএম কুক্ষিগত করে রেখেছে। কারণ, সিপিএম সাংসদদের বরাদ্দ করা টাকায় গ্রন্থাগারটি তৈরি হয়েছিল। পরিচালন সমিতি কোনও নির্বাচন করায় না। অথচ প্রতিষ্ঠানটা চালাতেও পারে না।’’ সিপিএমের ‘অপদার্থতা’র জেরেই বঙ্কিমের নামাঙ্কিত গ্রন্থাগার ঘিরে এত বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলে তৃণমূলের দাবি।

    সোমবার দুপুরে বঙ্কিমের বাড়ির সামনেই তৃণমূলের ভাস্করের সঙ্গে গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতির সদস্য সমীর গুনিনের একপ্রস্ত বাদানুবাদও হয়। সমীরকে দেখেই তৃণমূলের ভাস্কর প্রশ্ন করেন, ‘‘কবে তোমরা ইস্তফা দেবে? তোমাদের অপদার্থতার জন্য রাজ্য সরকারকে গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে।’’ সমীর বলেন, ‘‘আমাদের এক সপ্তাহ সময় লাগবে। আলোচনা রয়েছে।’’ ভাস্কর সে কথা শুনে তেড়ে উঠে বলেন ‘‘একটা ইস্তফা দিতে এক সপ্তাহ? আমি অত সময় দেব না। বুধবার পর্যন্ত সময় দিলাম। তার মধ্যে ইস্তফা দাও। না-হলে আমরা নিজেদের মতো কমিটি গড়ে নেব।’’

    পরিচালন সমিতির সম্পাদক প্রবীর বসু নাট্যকর্মী। তিনি ফোনে আনন্দবাজার ডট কম-কে বললেন, ‘‘অপদার্থতার অভিযোগ বাইরে থেকে তোলাই যায়। কিন্তু রাজ্য সরকারের গ্রন্থাগার দফতরই তো লিখিত ভাবে জানিয়েছে যে, এই গ্রন্থাগার সপ্তাহে দু’দিন খোলা থাকবে— মঙ্গল আর শুক্রবার। একজন কর্মীকে দিয়ে সরকার চারটি গ্রন্থাগার চালাচ্ছে। তাই এই বন্দোবস্ত।’’ শুক্রবার যখন গ্রন্থাগার খোলা থাকার কথা, তখন শুভেন্দুরা তা শুক্রবারে খোলা পেলেন না কেন? প্রবীর বলছেন, ‘‘গ্রন্থাগারের একমাত্র কর্মী অসুস্থ ছিলেন বলে আসেননি।’’

    ‘যুক্তিতর্ক’ যা-ই থাক, বিতর্কের ধাক্কায় পরিচালন সমিতি কিন্তু টালমাটাল। সম্পাদক জানিয়েছেন, তিনি আর দায়িত্বে থাকতে চান না। আনন্দবাজার ডট কম-কে তিনি বলেছেন, ‘‘আর কেউ ইস্তফা দেবেন কি না বলতে পারব না। আমি দেব। আমার আর ভাল লাগছে না।’’

    বঙ্কিম সত্যিই পথ হারাইয়াছেন!
  • Link to this news (আনন্দবাজার)