মাতৃ-আরাধনার ঋতু শেষ। অশুভকে বিনাশ করল শুভশক্তি। পরম শুভাকাঙ্ক্ষী জগন্মাতা রণরঙ্গিনী মূর্তিতে অনাচারী অসুরকে বধ করলেন। আমরা আলো জ্বেলে কালোকে ঘোচালাম, মা নিজেই কালো মেয়ের রূপ ধরে আমাদের সহায় হলেন। তাই এই কালো মেয়ের পায়ের তলায় আমরা আলোর নাচন দেখি— চমৎকার সব প্রতীক! সে সব আবার ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের চেতনায় দৃঢ়প্রোথিত। আমাদের পূর্বপুরুষদের কল্পনাশক্তির তারিফ করতেই হয়। কিন্তু প্রতীক তো প্রতীকই, বাস্তব নয়। বাস্তবটা তা হলে কেমন?
আমরা যখন দুর্গাপূজায় মাতি, কাছাকাছি অনেক জনজাতিভুক্ত মানুষ, বিশেষত ‘অসুর’ নামে চিহ্নিত সম্প্রদায়, শোক পালন করেন। এর পটভূমি বহিরাগত আগ্রাসকদের প্রেরিত ছলনাময়ী এক নারীর হাতে তাঁদের পরাভবের উলট-পুরাণ। ইদানীং অবশ্য তাঁদের প্রতিবাদও অভিব্যক্তি পাচ্ছে মহিষাসুর তথা হুদুড় দুর্গার পুজোয়, কিন্তু তার কোনও স্বীকৃতি নেই মূলধারার ধর্মে। আসলে এই মানুষগুলোর জন্য আমাদের কোনও সংবেদনা নেই, আমাদের প্রতীক-কেন্দ্রিক হুল্লোড়ের জন্য কষ্ট পেলই বা বাস্তবে রক্তমাংসের কিছু মানুষ!
তেমনই কালোকে অসুন্দর ও অশুভের প্রতীক করে তুলে আমরা কালো মানুষদের ঘৃণা করি, কালো মেয়েদের হেনস্থা করি। অথচ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভব ‘ব্ল্যাক হোল’ থেকে, অন্ধকার মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর জন্ম। আর, সব মানুষেরই আদিভূমি আফ্রিকা, যেখানে সবার গায়ের রং কালোই ছিল (শৈত্যপ্রধান উত্তরে পরিযাণের ফলে রং ফরসা হয়ে ওঠে ভিটামিন ডি মেটাবলাইজ় করার জন্য)। তা ছাড়া ‘আলোর পথযাত্রী’ হতে চেয়ে আমরা ভুলে যাই তার জন্য ঘনঘোর রাত্রি পেরোতে হয় অনেক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে; রীতিমতো সাধনা করতে হয়। জীবনের কঠিন সত্যের এই উপলব্ধি যে আমাদের পূর্বপুরুষদের ছিল, তার পরিচয় আছে দেশবিদেশের পুরাণে রূপকথায়। শ্মশানচারিণী ভয়ঙ্করী কালীর আরাধনাও তাই। তাই তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের দুরূহ পথের পথিকদের পূজ্য। আজ অবশ্য আমাদের জীবন তথা প্রতীক-চর্যায় সাধনা-টাধনা মূল্যহীন। ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’ নয়, ইলেকট্রিক বাল্বের উগ্র ঝলকানিতে চার দিক ধাঁধিয়ে, বেদম বাজির তাণ্ডবে মানুষ-সহ প্রাণিকুলের প্রাণান্ত করে চলে আমাদের উদ্দাম উল্লাস।
মানুষ কল্পনাপ্রবণ প্রাণী এবং কল্পনার কেন্দ্রস্থলে প্রতীকের ভূমিকা। বিশাল ও জটিল বাস্তবের অনুকল্প হিসাবে প্রতীক বাস্তবটাকে বুঝতে আমাদের সুবিধা করে দেয়। তাই বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় প্রতীকীয়ানা আমাদের মস্তিষ্কে সুপ্রতিষ্ঠিত। তা ছাড়াও প্রতীক প্রতি দিনের বাহ্যিক বেঁচে-থাকাকে ছাপিয়ে জীবনের গভীরতর অর্থ খুঁজে পেতে আমাদের সাহায্য করে, জীবনকে মহত্তর মূল্যে ভূষিত করে। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মস্তিষ্কে প্রতীক আর বাস্তবের বড়ই নৈকট্য; এমনকি বিভ্রান্তিরও সম্ভাবনা। প্রতীকের বিপুল শক্তি এই কারণেই। নিজের দেশ-ধর্ম-সংস্কৃতির কোনও প্রতীকের জন্য মানুষ প্রাণও দিতে পারে। তাই শিখ বীর তরু সিংহ নবাবের অনুগ্রহ প্রত্যখ্যান করে বলেন, ‘যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব/ বেণীর সঙ্গে মাথা।’ কিন্তু অন্য দিকে প্রতীক আমাদের সঙ্কীর্ণমনা, পরস্পরবিদ্বেষী করে তুলতে পারে। নিজেদের প্রতীককে গুরুত্ব দিতে গিয়ে, অন্যের প্রতীককে আমরা প্রায়ই অশ্রদ্ধা করি, নিজের প্রতীক দিয়েই সমগ্র বাস্তবের দখল নিতে চাই।
ধ্বংসাত্মক দিকটা বিশেষ করে প্রকটিত আজকের অস্মিতার রাজনীতিতে। একদা নাহয় প্রতিবেশী হিসেবে যারা পাশাপাশি থাকত তারা মোটামুটি একই রকম প্রতীকে বিশ্বাস করত। কিন্তু আধুনিক যুগে তো নানান প্রতীকে বিশ্বাসী নানা রকম মানুষ পরস্পরের প্রতিবেশী। আধুনিক মানুষ যদি সেই বাস্তবকে উপেক্ষা করে অন্যের প্রতি আগ্রাসী হয়ে ওঠে, প্রতীক অর্থের বদলে অনর্থের আবাহন করে। স্নায়ুবিজ্ঞানী স্যাপলস্কি তাই প্রতীককে বলেছেন ‘ডাবল-এজ্ড সোর্ড’। তাই মানুষ প্রতীক-নির্ভর বটে, কিন্তু বাস্তব আর প্রতীকে পার্থক্য করাটাও আধুনিক যুক্তিবাদী মানুষের কাছে প্রত্যাশিত। স্নায়ুবিজ্ঞানী রামচন্দ্রন বলেন, এই পার্থক্য যে করতে পারে না, সে ‘স্কিটজ়োফ্রেনিক’।
সামূহিক স্কিটজ়োফ্রেনিয়া বা ভগ্নমনস্কতার উল্লেখযোগ্য উৎস আর এক মাতৃদেবী— দেশমাতৃকা। এও এক চমৎকার কল্পনা— দেশের প্রতি গভীর টানও যেমন তৈরি করে, তেমনই দেশবাসীর সঙ্গে সৌভ্রাত্রবোধের ভিত্তিতে জাতীয়তার বোধও ঘনীভূত করে। কখনও পুরাণের কোনও দেবীর— দুর্গা বা কালীর সঙ্গে দেশমাতৃকা সমীকৃত। অধিকাংশত কিন্তু দেশের গাছপালা, খেত, নদী ইত্যাদি দিয়ে তাঁর ‘সেকুলার’ মূর্তি তৈরি হয়েছে। এ ধরনের রূপকল্প আমাদের সাংস্কৃতিক অভ্যাসে পরিণত হয়, ভাষার অলঙ্কার হয়ে ওঠে। ভাষাই হয়তো ভাবনা হয়ে উঠে যারা মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নয়, তাদেরও আবেগাপ্লুত করে। কায়কোবাদ থেকে শুরু করে বেশ কিছু মুসলমান কবির কবিতায় দেশমাতার প্রতি আকুল আত্মনিবেদন পাই, যত দিন না হিন্দু-মুসলমান দুই তরফেই সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্ত হয়। ক্রমে উপমহাদেশ জুড়ে অনেকের কাছেই দেশ হয়ে উঠল দ্বেষ। আজ তার যে খণ্ডিত অংশে বাস করি, সেখানে দেখছি দেশমাতাকে একান্ত হিন্দু দেবী বানিয়ে অ-হিন্দুদের উপরেও আরোপের চেষ্টা, অ-হিন্দিভাষীদেরও ‘ভারতমাতাকি জয়’ বলতে বাধ্য করা, ফের খুঁচিয়ে তোলা ‘বন্দে মাতরম্’ বিতর্ক।
সুন্দর প্রতীকগুলিকে এই ভাবেই আমরা কুৎসিত করে তুলি। বোঝা দরকার, কোনও প্রতীকেরই অতি-প্রসারণ বা কদর্থ অবাঞ্ছিত। অন্যের প্রতীককেও শ্রদ্ধা করা জরুরি। এটা বোঝেননি বলেই হিন্দু দেবদেবী, তাঁদের মাথা বা হাতের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অনেকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছেন। এঁদের বোঝানোর জন্য বিবেকানন্দোচিত প্রজ্ঞার প্রয়োজন। অলওয়ারের মহারাজা হিন্দুদের মূর্তিপূজার নিন্দা করলে বিবেকানন্দ মহারাজার প্রয়াত পিতার প্রতিকৃতি দেওয়াল থেকে নামিয়ে তাঁকে বলেন ছবিটিতে পদাঘাত করতে। মহারাজ স্বভাবতই ক্রুদ্ধ। বিবেকানন্দ বুঝিয়ে দেন— ছবিও তো জড়বস্তু মাত্র, তবুও তো তা প্রতীক হিসেবে মহারাজার কাছে পিতারই মর্যাদা দাবি করে। আজকের দেশপ্রেমিকদের গাজোয়ারি করে সবাইকে দিয়ে ‘ভারতমাতাকি জয়’ বলানো ওই মহারাজার মানসিকতারই ওল্টানো অভিব্যক্তি। তার সঙ্গে আগ্রাসী স্বার্থান্বেষণও আছে। বস্তুত এঁরা ‘হিন্দুত্ব’-এর প্রতীক দিয়ে গোটা জাতিরাষ্ট্রের, আবার কিছু বাছাই ধর্মীয়/সাংস্কৃতিক প্রতীক দিয়ে ‘হিন্দু’ ধারণাটার দখল নিতে চান। এটাকে বলা যায় ‘রিডাকশনিজ়ম’, বাস্তবের একটা অংশকে প্রতীকের বদলে গোটা বাস্তব বলে গণ্য করা। পুরাণকে যাঁরা ইতিহাস বলে দাবি করেন, তাঁরা ওই মহারাজার মতোই আমাদের পিতৃপুরুষদের কল্পনাশক্তিকে অপমান করেন ।
অবশ্য দেশমাতা যখন হিন্দু দেবী নন, স্বদেশপ্রকৃতির সঙ্গে একীভূতা, তখনও সমস্যা হতে পারে। লক্ষণীয়, আমাদের জাতীয়তাবাদী গান-কবিতায় দক্ষিণবঙ্গের প্রকৃতিই প্রধানত এসেছে, ‘গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর’ ইত্যাদি; কারণ অধিকাংশ কবি ছিলেন দক্ষিণের সমতলের মানুষ। এও কিন্তু ‘রিডাকশনিজ়ম’, যার জেরে আজ উত্তরবঙ্গীয়রা বাকি বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করেন।
মনে রাখা দরকার, প্রতীককে রক্তমাংসের বাস্তবের উপর গুরুত্ব দিলে কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। তাই এত মাতৃ-আরাধনা সত্ত্বেও বাস্তবে মায়েদের তথা মেয়েদের হীনাবস্থা ঘোচে না। বরং ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, দেশমাতৃকার প্রতিচ্ছায়া হিসেবে জাতিগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ নারীকে অনেকটা সীমাবদ্ধ করে দেয়। ‘নারী-মাতা-নেশন নেক্সাস’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত গোমাতাকে ভক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে গোমাংস-খাদক সন্দেহে কোনও মানুষকে হত্যা করা যায়, মহিষাসুর বধের উদ্যাপনে একটি নিরীহ মহিষকে বলি দেওয়া যায়।
আর আমাদের ‘প্রগতিপন্থী’ প্রতীকী প্রতিবাদ? যেমন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘটা করে গোমাংস খাওয়া (বহুজনের ভাবাবেগকে তুচ্ছ করে) বা ইদানীং বহুপ্রচলিত মোমবাতি মিছিল? আমরা যদি ‘টোকেনিজ়ম’-এই তৃপ্তি পেয়ে বাস্তবের সঙ্গে আপস করে চলি, তাতে কিন্তু বাস্তবটা বদলায় না। আমরা প্রতীক নিয়ে মেতে থাকি, আর বাস্তবটা তছনছ হতেই থাকে!