• কেন খারিজ এত মেয়ে
    আনন্দবাজার | ১১ নভেম্বর ২০২৫
  • বিহারের ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর পর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে পুরুষদের তুলনায় ৭.২ লক্ষ মহিলার নাম বেশি কাটা গিয়েছে। প্রথম খসড়ায় পুরুষদের নাম কাটা গিয়েছিল ২৯.৩ লক্ষ আর মহিলাদের ৩৬.৫ লক্ষ। অথচ ভারতের অনেক রাজ্যের মতো, বিহারের জনসংখ্যাতেও পুরুষের তুলনায় মহিলার সংখ্যা কম। প্রতি এক হাজার পুরুষে মহিলার সংখ্যা ৯৩৪ জন। তা হলে বাতিলের তালিকায় বেশি মহিলার নাম এল কী করে?

    দেখা যাচ্ছে, ‘স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত’ বিভাগে মহিলাদের নাম বেশি কাটা গেছে। সাংবাদিক এবং সমাজতাত্ত্বিকরা দেখেছেন যে, এর মূল কারণ বিবাহজনিত স্থানান্তর। ভারতে অধিকাংশ জনসমাজে বিয়ের পরে মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে স্থায়ী ভাবে শ্বশুরবাড়ি চলে যান। সেটা রাজ্যের বাইরে হতে পারে, বা রাজ্যের মধ্যেই অন্যত্র হতে পারে। এই স্থানান্তর সামাজিক প্রথা। এসআইআর, যা একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, তা একটি সামাজিক প্রথাকে রাষ্ট্র মহিলাদের অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।

    শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর বধূর নাম একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সেখানকার ভোটার তালিকা-সহ বিভিন্ন নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না কেন, সেই প্রশ্নটা এত দিন পরে জোরের সঙ্গে উঠে আসছে। এত দিন কেউ এটা নিয়ে সে ভাবে চিন্তা করেনি, এটাই আশ্চর্য। ফলে ‘বিবাহের কারণে স্থানান্তর’ মহিলাদের বিরাট বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে একই কারণে এসআইআর হলে লক্ষ লক্ষ মহিলার নাম কাটা যাওয়ার আশঙ্কা।

    ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য যা যা বৈধ নথি বলে রাখা হয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল জমির মালিকানা এবং সরকারি আবাস বরাদ্দের কাগজ। বাস্তব এটাই যে প্রান্তিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই শুধু নয়, আর্থ-সামাজিক ভাবে অগ্রসর গোষ্ঠীদের মধ্যেও মহিলাদের নামে উত্তরাধিকার সূত্রে জমি, বাড়ি থাকে না। তাই নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণপত্র হিসেবে জমির কাগজ বা বাড়ি বরাদ্দের কাগজ দেখানো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব ছিল না। আরও দু’টি প্রমাণপত্র উচ্চশিক্ষা এবং সরকারি চাকরি-সংক্রান্ত নথি। এ দু’টিও বিহারের গ্রামের অনেক মহিলার পক্ষে দেওয়া অসম্ভব।

    আর একটি সমস্যা, বিয়ের পরে মেয়েদের পদবি বদলে যায়, অনেক সময়ে নামও। বিয়ের আগের এবং পরের নানা পরিচয়পত্রে অসঙ্গতি থেকে যায়।

    এসআইএর-এর সবচেয়ে আপত্তিকর দিক এই যে, নথিপত্র পেশ করে ভোটাধিকার রক্ষার জন্য নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নাগরিকের উপরে। এটা ন্যায়ের পরিপন্থী। যাঁরা এই নিয়ম করেছেন, তাঁরা ভালই জানেন যে ভারতের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী— দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, মহিলা, উদ্বাস্তু, গৃহহারা মানুষের বৃহৎ অংশ এই সব শর্ত মেটাতে পারবেন না। বিহারের মহিলারা আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থানে খুবই দুর্বল। বিপুল সংখ্যক মহিলা যে নির্ধারিত প্রমাণপত্র-সহ নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ‘এনুমারেশন ফর্ম’ জমা দিতে পারবেন না, তা জানাই ছিল। ২০২৫ সালের পয়লা জানুয়ারিতে তৈরি ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, এমন পাঁচ লক্ষেরও বেশি মহিলা তাই বাদ পড়ে গেলেন প্রথম তালিকায়। বৈধ নথিপত্র জমা দেওয়ার এই কঠোরতায় এত মেয়ের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে কী লাভ হল দেশের?

    বিহারের অভিজ্ঞতা যা দেখাচ্ছে তা হল, এসআইআর হচ্ছে ভোটার তালিকা থেকে নাগরিকের নাম বাদ দেওয়ার বা বিযুক্তকরণের একটা প্রক্রিয়া। অথচ, নির্বাচনী আইন অনুযায়ী এটা হওয়ার কথা অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া। ভারতের মতো একটি দেশে এক জন ব্যক্তির ব্যক্তিগত নথিপত্রকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে ধরে নাগরিকত্ব যাচাই করার এই কার্যসূচি আগামী দিনে কোটি কোটি মানুষকে বেনাগরিক করবে, তা প্রায় অনিবার্য।

    অসমের এনআরসি-তে তাই হয়েছে। অসমে এনআরসি তালিকা তৈরির সময়ে যে ১৯ লক্ষ ভোটারের নাম কাটা গেছে তার বড় অংশ মহিলা, প্রায় ৬৯ শতাংশ। অসমে ছিল ‘লিগ্যাসি’ অর্থাৎ পিতৃ-পরিচয়ের সঙ্গে মহিলার বিবাহ-উত্তর পরিচয় মেলানোর সমস্যা। সেটা করতে না পারায় বিপুল সংখ্যক মহিলার নাগরিকত্ব কাটা যাওয়ার বড় কারণ। একই সঙ্গে জমির নথিতে মেয়েদের নাম না থাকা, বা সরকারি চাকরিতে মহিলাদের সামান্য উপস্থিতিও নাম কাটার কারণ ছিল।

    এক অর্থে এসআইআর অসমের এনআরসি-র থেকেও ভয়ঙ্কর। কারণ এনআরসি-তে তালিকা তৈরির কাজের উপর বিচারব্যবস্থার একটা নজরদারি ছিল। নাগরিকের জন্য অন্তত দু’বার আইনের সুযোগ নেওয়ার অধিকার ছিল। কিন্তু এসআইআর-এ পুরো প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক, আধিকারিকদের সিদ্ধান্তই এখানে চূড়ান্ত। ভোটার তালিকায় নাম থাকা বা না-থাকার সিদ্ধান্ত বাস্তবে নিচ্ছেন নিম্ন স্তরের সরকারি আধিকারিকরা, বা দু’-এক ঘণ্টার ট্রেনিং-পাওয়া প্রাথমিক শিক্ষকরা। এবং এখানে বিচারব্যবস্থার হস্তক্ষেপেরও সুযোগ নেই। এটা খুবই মারাত্মক পরিস্থিতি।

    অন্যায় শর্ত, ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া আরোপ করায় ভোটার তালিকা থেকে বিপুল সংখ্যায় মেয়েদের নাম খারিজ হলে তা যেমন মেয়েদের প্রতি অন্যায় হবে, তেমনই তার প্রভাব পড়বে রাজনীতিতে। নাগরিক সমাজ ও নারী আন্দোলনকে তৎপর হয়ে এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)