স্বাস্থ্য নিয়ে সমাজমাধ্যমে কুৎসা, অপপ্রচার রুখতে আলাদা লোক রাখা উচিত স্বাস্থ্যসচিবের! মঙ্গলবার ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল ইউনিটের উদ্বোধনে গিয়ে এমনটাই বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে আরও এক বার রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানালেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গ্রহণ না করলেই বাতিল করা হবে লাইসেন্স।
রাজ্যে ২১০টি স্বয়ংসম্পূর্ণ মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট উদ্বোধনের জন্য উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরেই স্বাস্থ্যভবনে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার বিকেলে সেখানেই স্বাস্থ্য পরিষেবার সমালোচকদের কটাক্ষ করে মমতা বলেন, ‘‘যারা (রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীরা) সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে কেউ লেখে না। সমাজমাধ্যমে অনেকে সব কিছু নিয়েই কুৎসা রটায়। নারায়ণকে (স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম) রোজ বলি, তোমার লোক রাখা উচিত এ সব মিথ্যা কথা ‘কাউন্টার’ করার জন্য!’’ মমতার কথায়, বেশি কথা লেখার দরকার নেই, দু’চার বাক্যে এ সবের উত্তর দিলেই হবে, কিন্তু জবাব দিতে হবে।
কুৎসা প্রসঙ্গে বলতে বলতে এর পরেই স্বাস্থ্য থেকে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনীতে চলে যান মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘এরা আবার অন্যের কাছে পরিচয় জানতে চায়! টাকা পায়, তার বিনিময়ে এ সব করছে। মিথ্যে কথা বলে বাংলার বদনাম করছে। দিল্লির বস্তির ছবি নিউটাউনের বলে চালাচ্ছে। ছেড়ে দেব? রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, কামড়াবে না, কিন্তু ফোঁস কোরো!’’ মমতার কথায়, তাঁদের সময়ে এত হাসপাতাল ছিল না। অনেকেই জন্মেছেন বাড়িতে। ফলে জন্মের শংসাপত্র পেতেও দেরি হত, বা তা হাতে পেলেও গরমিল থাকত তারিখের হিসাবে। সে সব মানুষকে এখন যদি জন্মের কাগজ দেখাতে বলা হয়, কী ভাবে দেখাবেন তাঁরা?
প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পরিষেবা
রাজ্য সরকারের মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মমতা ছাড়াও ছিলেন স্বাস্থ্যসচিব, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে থাকা ব্যক্তিরা। ভ্রাম্যমাণ এই স্বাস্থ্য ক্লিনিকে নার্স, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে যাবতীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুযোগসুবিধা থাকবে। মমতা জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত এমন ২১০টি ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম দফার ১১০টি ইউনিট মঙ্গলবারই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় রওনা দেবে। এই ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে হিমোগ্লোবিন, ম্যালেরিয়া, ইসিজি, সুগার-সহ ৩৫টি পরীক্ষা বিনামূল্যে করা যাবে। এতে সবথেকে বেশি সুবিধা পাবেন শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা। তা ছাড়া, কোনও রোগীকে স্থানান্তর করার জন্যও এগুলি কাজে লাগবে। বিশেষত জঙ্গলমহল, সুন্দরবন কিংবা পাহাড়ের মতো প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে পরিষেবা দিতে পারবে এই ভ্রাম্যমাণ যান। এই প্রকল্প চালাতে মাসে প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা করে খরচ হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
স্বাস্থ্যসাথী
রোগীদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড প্রত্যাখ্যান করায় অতীতে একাধিক বার বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি, এ নিয়ে আইন প্রয়োগ করে প্রয়োজনে হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশিকাও জারি করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু অভিযোগ, তার পরেও কিছু কিছু হাসপাতালের টনক নড়েনি। মঙ্গলবার তা নিয়ে ফের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মমতা। মমতা বলেন, ‘‘কেউ কেউ আছে যারা স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে গেলে নিতে চায় না। যে নিতে চায় না তার তো লাইসেন্স থাকার প্রয়োজন নেই! এ ব্যাপারে আমি খুব রাফ অ্যান্ড টাফ। আপনাদের তো রাজ্য সরকারই বিমার টাকাটা দিচ্ছে। তা হলে কেন ‘না’ বলছেন?’’ মমতা জানিয়েছেন, সম্প্রতি বারাসাতের এক বেসরকারি হাসপাতাল এক হৃদ্রোগীকে জানিয়েছিল, চিকিৎসা খরচের পাঁচ লক্ষ টাকার মধ্যে দু’লক্ষ টাকা স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প থেকে পাওয়া যাবে, বাকিটা নগদ টাকায় দিতে হবে। খবর পেয়েই স্বাস্থ্যসচিবকে ফোন করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘নারায়ণকে বললাম, শো কজ় করো। নয়তো লাইসেন্স বাতিল করে দাও। এটা অন্যায়। যাঁরা এমনটা করছেন, তাঁদের কাছে অনুরোধ, এটা করবেন না।’’
কেন গাফিলতি?
২০১৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিজের হাতে কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন মমতা। তার পর আট বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মমতার নিজের দফতরের ‘গাফিলতি’তেই এত দিনেও সেই কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক কার্যকর হয়নি। মঙ্গলবার স্বাস্থ্যভবনে তা নিয়ে ফের উষ্মাপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি জানিয়েছেন, এসএসকেএম বা পিজি হাসপাতালেও কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরির কথা ভাবছেন তিনি। মমতা বলেন, ‘‘আমি চাই পিজিতেও কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক করা হোক। মেডিক্যাল কলেজে আগে করেছিলাম। সেটাও অনেক দিন হয়ে গেছে। এখনও সেটা কেন কার্ষকরী হচ্ছে না? নিশ্চয়ই কারও না কারও দায়িত্বে অবহেলার জন্যই এটা হচ্ছে। আশা করব দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এটা দেখবেন।’’
পাশাপাশি, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নিয়োগ স্থগিত থাকা নিয়ে মমতা বলেন, ‘‘আমরা ১৪ হাজার ডাক্তার নিয়োগ করেছি। আদালতে মামলা চলার জন্য কিছু দিন নিয়োগ আটকে ছিল, কিন্তু এখনও কেন আটকে আছে? নারায়ণকে বলব এটা সিরিয়াসলি নিতে। হেড রিক্রুটমেন্ট বোর্ডকে বলো, তারা যেন কাজে গতি আনে। আমি তো কারও কাজে নাক গলাই না! কিন্তু দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের কাজের ফল দেখতে চাই।’’
স্বাস্থ্যে ‘বিপ্লব’
তৃণমূল আমলে রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ‘আমূল পরিবর্তনের’ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘গত ১৩-১৪ বছরে স্বাস্থ্যে বিপ্লব হয়েছে, কেউ তার খবর রাখে?’’ নিজের বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি হিসাবে নানা পরিসংখ্যানও তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা জানিয়েছেন, রাজ্যে ৪২টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। গড়া হয়েছে ১৪টি নতুন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ। নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫৭ থেকে বেড়ে ৪৫১ হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়নে ৭০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এসএসকেএম হাসপাতালে একটি অরগ্যান ব্যাঙ্ক তৈরির পরিকল্পনা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে একটি লিভার ও হার্ট ব্যাঙ্ক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান এবং সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে অ্যাডভান্স লিনাক মেশিন-সহ ক্যানসার চিকিৎসার সেন্টারও শীঘ্রই তৈরি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা বলেন, ‘‘সুন্দরবনে যে থাকে, যে জঙ্গলে থাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তাদের জন্য এখন মাদার ওয়েটিং হাট করা হয়। যখন গর্ভবতী মা সন্তানের জন্ম দেন, তখন হাসপাতালের পাশে মায়ের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, আগে কোনও পথদুর্ঘটনা ঘটলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই রোগী মারা যেতেন। এখন যাতে তা না হয়, সে জন্য ৪৯টি ট্রমা কেয়ার সেন্টার হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মহিলা চিকিৎসকদের জন্য আলাদা হস্টেল, ক্লাব গ্রাউন্ড থেকে শুরু করে অনেক কিছুই হয়েছে তাঁর আমলে।
উদ্বেগ নিরাপত্তা নিয়েও
মঙ্গলবার হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন মমতা। এসএসকেএমের মতো বেশির ভাগ হাসপাতালের এক বিল্ডিং থেকে আর এক বিল্ডিংয়ের কোনও বিভাগে যেতে গেলে বেশ কিছুটা সময় লাগে। বিশেষত রাত্রিবেলা অন্ধকারে অসুবিধায় পড়তে হয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। নিরাপত্তা গলদের এই দিকটি উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘রাতের বেলা ছেলেমেয়েরা যেন এক বিল্ডিং থেকে আর এক বিল্ডিংয়ে সরাসরি যেতে পারে, এই ব্যবস্থা করতে হবে। অন্ধকার জায়গাগুলোয় খারাপ মতলব নিয়ে অনেক বদমাশ লুকিয়ে থাকতে পারে। হাসপাতাল থেকে তো কাউকে চলে যেতে বলা যায় না। কিন্তু ভাইদের বলব বোনদের দেখে রাখতে, যাতে ভবিষ্যতে কোনও খারাপ ঘটনা না ঘটে।’’
উল্লেখ্য, গত বছর অগস্ট মাসে খাস আরজি কর হাসপাতালে ঢুকে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘিরে তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলা। দিন কয়েক আগে এসএসকেএমেও এক নাবালিকা রোগিণীকে শৌচাগারে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। সেই আবহে এ বার হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ শোনা গেল মমতার মুখে।